এফএনএস : বাংলাদেশের অগ্রগতি নাগরিক হিসেবে দেশের প্রত্যেক ব্যক্তিকে আনন্দিত করে। কিন্তু এই অগ্রগতি যদি হয় নেতিবাচক ক্ষেত্রে তবে তা আনন্দের কারণ না হয়ে হয় আক্ষেপের কারণ। স¤প্রতি দেশের এমনি এক নেতিবাচক আগ্রগতির সংবাদ এসেছে যা ব্যথিত করেছে এদেশের মানুষকে। এই অগ্রগতিটা এসেছে দুর্নীতিতে। দুর্নীতিতে এক ধাপ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। গতবছর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম। এ বছর বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে ১৩তম অবস্থানে এসেছে। কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায়ও এক ধাপ অবনমন ঘটে ১৪৬ থেকে ১৪৭তম অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। আর এশিয়ার মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় এবং আফগানিস্তানের নাম এক নম্বরে রয়েছে। স¤প্রতি বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২১’ এর বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি বিষয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। কারণ, ১০ বছর ধরে প্রবণতা হলো স্কোরটি এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলেও সেটি ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে না। কারণ, যাদের হাতে এই দায়িত্ব তাদের একাংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের এই অবস্থানে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে। নতুন রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬ থেকে বেড়ে ১৪৭তম হয়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়নসংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে এবারসহ টানা ৪ বছর বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি। রাজনীতির কারণেই মূলত দেশে দুর্নীতির বিকাশ ঘটছে। আর ক্রমাগত দেশকে গ্রাস করছে দুর্নীতির দুষ্টচক্র। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি বহুল চর্চিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা হয়ে গেছে অতিসাধারণ। দেশের মানুষ এই ব্যাপারের সাথে এমন সহনীয় হয়ে উঠেছে যে এটি এখন তাদেরকে খুব একটা আশ্চর্য করে না। বিভিন্ন নীতি ও তার প্রয়োগ ক্রমাগত জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতাবানদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি কাজে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্রতা এবং রাঘববোয়ালদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ব্যর্থতা রয়েছে। গণমাধ্যমে যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করছেন, তাদের হামলা-মামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যেমন ধ্বংস করছে, তেমন সরকারের সৎকর্মশীলতাকেও বাধাগ্রস্ত করছে। জানা যায়, দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৮৯ শতাংশ মানুষ সরকারি সেবা নিতে ঘুস দিতে বাধ্য হন। ঘুস ছাড়া সরকারি সেবা অসম্ভব। দুর্নীতি আমাদের সাধারণ জীবনাচারের অংশ হয়ে যাচ্ছে। ফলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। তবে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক ‘যদি-কিন্তু’ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশে আইন আছে, রাজনৈতিক অঙ্গীকারও আছে। কিন্তু যাদের ওপর এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ভার, তাদের একাংশই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এরা দুর্নীতির ফলে লাভবান, দুর্নীতিকে সুরক্ষা ও প্রসারে কাজ করেন। অবস্থার উত্তরণে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বলতে গেলে বাংলাদেশে দুর্নীতি এক ধরণের শিল্পে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিতে তাই বিভিন্ন সময় দেখা যায় শৈল্পিক চতুরতা। দুর্নীতি এখন উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের থেকে শুরু করে জনগণের কাছে পৌঁছে গেছে। সরকারের কার্য সম্পাদনকারী মৌলিক সব প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন গবেষণা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত করেছে। প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চমাত্রার দুর্নীতি ও রাজনীতিকীকরণ পরিলক্ষিত হয় বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রত্যেক সরকার দুর্নীতি নির্মূলের অঙ্গীকার করলেও আমাদের দেশে দুর্নীতির এক ধরনের সামাজিকীকরণ হয়েছে। শুধু এবার নয়, এ দেশ কয়েক বার দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থানে ছিল। দুর্নীতি আসলে একটি ব্যাপক টার্ম। আমাদের সমাজে দুর্নীতি বলতে সরকারি অফিসে ঘুষ গ্রহণকেই মৌলিকভাবে বুঝে থাকি। ঘুষ গ্রহণ দুর্নীতির একটি ধরন। কিন্তু আরও অনেক প্রকৃতির দুর্নীতি আমাদের দেশে বিদ্যমান, যা ঘুষের চেয়ে অনকে ভয়াবহ। ঘুষের দুর্নীতি সহজে দেখা যায়, আলোচিত হয়। কিন্তু জনগণের সম্পদের অপব্যবহার, সরকারি সম্পদ লুট, জনঅধিকার চর্চা করতে না দেওয়া, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ চুরি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মতো বড় ধরনের দুর্নীতি দমন না করে শুধু সরকারি অফিসের দু’চার জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতারের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। এজন্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, মৌলিকভাবে দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে রাজনৈতিক দুর্নীতি দূর করতে হবে। দুর্নীতি দমনের জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষ কমিশনই রয়েছে। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। কিন্তু এই কমিশন এখন পর্যন্ত তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। কিছুক্ষেত্রে কাজ করলেও বৃহৎ অর্থে বলতে গেলে এই কমিশন দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে এ কমিশনকে। দল-মত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক নেতার দুর্নীতি তদন্ত করে দোষীদের নিরপেক্ষভাবে শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার পেছনে মৌলিক কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক শক্তি দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না। কৌশলে এ কমিশনকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছে। অথচ এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে হংকং, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতি দমন করে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে। আসলে দুর্নীতি দমনের জন্য সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হলো সদিচ্ছা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি নির্মূলে যতই সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক না কেন, এসব সিদ্ধান্ত রাজনীতিবিদদেরই বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন রাজনৈতিক এলিটরা করে থাকেন। বাস্তবে আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের সংস্কার ও দুর্নীতির প্রতি তাদের আচরণ পরিবর্তন খুবই কঠিন কাজ। এটা আশা করা ঠিক হবে না যে, ক্ষমতাসীনরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের আচরণ পরিবর্তন করবেন। কারণ স্বাধীনতার এত বছর পরও তারা তাদের আচরণ পরিবর্তন করেননি। তাদের অন্তর পরিবর্তন করা খুবই কঠিন। কারণ তারাই দুর্নীতির মাধ্যমে টিকে থাকেন, তারাই দুর্নীতির কারণে লাভবান। বর্তমানে জোর করেও অর্থবহ পরিবর্তন সম্ভব নয়।