রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
সুন্দরবনে বিএসএফের রেখে যাওয়া ৭৫ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর দেবহাটা বিএনপির সদস্য নবায়ন উদ্বোধনী আয়োজনে জেলা বিএনপির আহবায়ক রহমাতুল্লাহ পলাশ বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন যুবদলের প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত কলারোয়ায যুবদল নেতার ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ মুন্সীগঞ্জে তাপদাহে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ শ্রীউলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত তারুণ্যের সমাবেশ সফল করতে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রস্তুতি সভা ভাড়াশিমলায় ২৫০ প্রান্তিক কৃষানের মধ্যে সবজির বীজ বিতরণ খুলনার সাবেক মহিলা কাউন্সিলর গ্রেফতার বসন্তপুর ফকিরপাড়া জামে মসজিদে বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল

দেশব্যাপী ঞ্জানের আলো ছড়াছে অনির্বাণ লাইব্রেরী

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২

কপিলমুনি প্রতিনিধি \ দেশব্যাপী ঞ্জানের আলো ছড়িয়ে চলেছে খুলনা জেলা পাইকগাছা উপজেলার অজপাড়া গায়ে অবস্থিত বাতিঘর খ্যাত মামুদকাটী অনির্বাণ লাইব্রেরী। এটির পরিসীমা এখন আর এলাকাময় নয়, এটির সীমারেখা এখন দেশব্যাপী। আর এ অর্জন ধরে রাখার জন্য আগামী তিন বছরের জন্য একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন একমাত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কপিলমুনি মেহেরুন্নেচ্ছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রহিমা আক্তার শম্পা ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন প্রভাত দেবনাথ। ২৫ ডিসেম্বর অনির্বাণ লাইব্রেরী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় এ কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন একঝাঁক প্রবীণ উপদেষ্টা পরিষদ। উপদেষ্টা পরিষদ ঘিরে রয়েছে মন্ত্রী, সচিব, ডিআইজি, এসপি, সাংবাদিক, কলামিষ্ট, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রাণ পুরুষেরা। মামুদকাটী গ্রামের জয়দেব কুমার ভদ্র (বর্তমানে ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ), মানিক ভদ্র, মামুদকাটি গ্রামের বিশ্বকর্মা মন্ডল ও হরিঢালী গ্রামের মৃণাল ঘোষ ১৯৯০ সালে গ্রামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। স্থানীয় যুবক স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সন্ময়ে ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু হয় অনির্বাণ লাইব্রেরির। গ্রামের যুবসমাজকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করা, বাল্যবিবাহ ও কুসংস্কারমুক্ত করে মানুষজনকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিয়ে আসা এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। হরিঢালী ইউনিয়নের হিন্দুপ্রধান এই গ্রামটিতে একসময় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। গত ৩২ বছরে লাইব্রেরির বদৌলতে বদলে গেছে গ্রামটি। বর্তমানে এখানে বাল্যবিবাহ হয় না। প্রায় প্রতিটি ঘরে রয়েছেন সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদে কর্মরত মানুষজন। শুধু পাইকগাছা কিংবা খুলনায় নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সামাজিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে এই লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরি অন্য দশটা লাইব্রেরি থেকে আলাদা। লাইব্রেরি ঘিরে গড়ে উঠেছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আর শুরুর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে এলাকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে বসে পাঠচক্র। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাপ্তাহিক বৈঠক বসে। সেখানে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়। লাইব্রেরির আয়োজনে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প, লাইব্রেরির পক্ষ থেকে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপন, কৃষকদের দক্ষতা বাড়াতে পরামর্শ ও বীজ-সার সরবরাহ, করোনাকালে ত্রাণ সহায়তা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, দুর্যোগে এলাকাবাসীর পাশে থেকে সহায়তা, মনিরউদ্দিন-অনির্বাণ বৃত্তি প্রদান, এসএসসি-এইচএসসি উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের নীলসাগর-অনির্বাণ বৃত্তি প্রদান, শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুলড্রেস প্রদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। লাইব্রেরিতে রয়েছে গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও নাটকসহ প্রায় ১৫ হাজারের বেশি বই। আছে বঙ্গবন্ধু কর্নার ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। শিশুদের আলাদা পড়ার ব্যবস্থা। লাইব্রেরিতে বসে সবার জন্য বই ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ রয়েছে। এখানে জাতীয়, স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা রাখা হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন পেয়েছে লাইব্রেরিটি। সদস্য-শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তায় ১১ শতাংশ জমি মধ্যে তিনতলা ভবন জুড়ে রয়েছে শুধুই ঞ্জানের ভান্ডার। লাইব্রেরির তিনতলা ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে রয়েছে ২৫০ জন দর্শক ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট হলরুম। যেখানে আছে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, সাউন্ড সিস্টেম, ডক্টরস চেম্বার এবং অফিস রুম। দোতলায় লাইব্রেরি রুম, কম্পিউটার ল্যাব, দুটি পৃথক রিডিং রুম এবং কমন রুম এবং গেস্ট রুম। তিনতলায় লাইব্রেরি রুমসহ পাঁচটি গেস্ট রুম। গত কয়েক বছরে দেশ ছেড়ে বিদেশের মানুষকে আকৃষ্ট করেছে এই লাইব্রেরি। ইতোমধ্যে দূর-দূরান্তের অনেকে লাইব্রেরির কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন। লাইব্রেরিটিকে শুধু বই পড়ার স্থানে সীমাবদ্ধ রাখেননি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা। এটিকে প্রগতিশীলতা, মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছেন।লাইব্রেরিতে সারা বছরই কোনও না কোনও কর্মসূচি থাকে। মহান স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের জন্মজয়ন্তী পালন করা হয়। বাংলা নববর্ষ উৎসব বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পালন করা হয়। এছাড়া প্রতি শুক্রবার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা সেবা পরিচালিত হয়। এসময় দরিদ্রদের মাঝে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি সপ্তাহে দুই দিন শিশুদের নিয়ে ছবি আঁকা, নাচ এবং গানের বিষয়ে শিশু একাডেমির আদলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অনির্বাণ লাইব্রেরি সংলগ্ন এলাকাকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিন হাজার মাটির পাত্র বিভিন্ন গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাখিদের জন্য তিনটি পৃথক স্থানে খাবার সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি প্রতি বছর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালিত হয়। পরিবেশ সংরক্ষণে লাইব্রেরির এসব উদ্যোগ সবার নজর কেড়েছে। পাইকগাছা ও তালা উপজেলার অসহায় ও সংগ্রামী নারীদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ, ছাগল এবং হাঁস-মুরগি পালনে সহায়তা দিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। করোনা এবং ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষকে ৩০ লাখ টাকা (খাদ্য, গৃহ নির্মাণ সামগ্রী এবং আমন বীজ) সহায়তা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে টর্নেডোতে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণসামগ্রী, পোশাকশ্রমিক বাবা-মায়ের অগ্নিদগ্ধ পাঁচ বছরের শিশু মারিয়ার চিকিৎসার দায়িত্ব, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিজস্ব দেড়শ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ‘অনির্বাণ ব্লাড ফর লাইফ’ সংগঠন কাজ করছে। অনির্বাণ লাইব্রেরি সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদে একটি মাঝারি ট্যুরিস্ট বোট তৈরি করা হয়েছে। যাতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নৌ-ভ্রমণ এবং সুন্দরবন ভ্রমণের সুযোগ পান স্থানীয়রা। সেইসঙ্গে সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটনের বিকাশ ঘটে। পাশাপাশি এলাকার ছাত্র ও যুবকদের জন্য ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাব চালু করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির জন্য লাইব্রেরি এবং আশপাশের ৫০ মিটার পর্যন্ত ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই লাইব্রেরি সবার জন্য একটি মডেল বলে উলে­খ করেছেন অনির্বাণ লাইব্রেরির পুনরায় নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক প্রভাত দেবনাথ। তিনি বলেন, লাইব্রেরিতে প্রতি বছর ছাত্রছাত্রীদের বই পড়া, কবিতা ও গানসহ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতা থাকে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পাশাপাশি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার দেওয়া হয়। বই পড়ার পাশাপাশি লাইব্রেরিতে কবিতা, গান শেখানো, এমনকি একাডেমিক পড়ায় সহায়তা করা হয়। এখান থেকে কৃষিবিষয়ক নানা তথ্য দেওয়া হয়। কেউ চাইলে চাকরির খোঁজ-খবর দেওয়া হয়। ৩২ বছর আগে যে স্বপ্ন নিয়ে লাইব্রেরির যাত্রা হয়েছিল আজ তা ছাড়িয়ে গেছে বলে উলে­খ করেছেন অনির্বাণ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ও বর্তমান সহ-সভাপতি মানিক ভদ্র। তিনি বলেন, আমরা সফল। এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের লাইব্রেরিকে অনুকরণ করে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এটি আসলে সবার জন্য অনুকরণীয়। অনির্বাণ শুধু লাইব্রেরি নয়, এই অঞ্চলের বাতিঘর। সুন্দরবন উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক ও দৈনিক কালের কন্ঠের স্ট্যাফ রিপোর্টার নিখিল ভদ্র বলেন, একটি লাইব্রেরির ছোঁয়ায় পুরো এলাকা বদলে গেছে। বর্তমানে এখানে আর বাল্যবিবাহ হয় না। প্রতিটি বাড়িতে শিক্ষিত মানুষজন আছেন। এসব সম্ভব হয়েছে পাঠাগারের কল্যাণে। লাইব্রেরি যে অন্তহীন জ্ঞানের আধার—তার বাস্তব প্রমাণ প্রত্যন্ত গ্রামের এই লাইব্রেরি। এখানে আলো ছড়ানোর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করা হয়। এর মাধ্যমে সামাজিক কুসংস্কার ছেড়ে আলোর পথে যাচ্ছেন গ্রামের মানুষজন। এলাকার প্রবীণ শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি হিসেবে আছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব অশোক মধাব রায় ও সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গণেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com