এফএনএস : দেশের খাদ্যশস্যের বাজার অস্থিতিশীলতা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খাদ্যের সরবরাহ নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীলতা ফেরাতে আমদানি বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে দেশে এক কোটি টনের বেশি খাদ্য আমদানি করতে হবে। কিন্তু বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য আমদানির পরিমাণ ইউএসডিএর প্রক্ষেপণকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিবারই বাজেটে খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধিতে কৃষি খাতের উন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়া হয়। তুলনামূলক অধিক জনসংখ্যার পাশাপাশি আমদানিনির্ভরতার কারণে আসন্ন অর্থবছরে খাদ্যশস্যের বাজার নিয়েও বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। খাদ্য আমদানিকারক এবং খাদ্য খাতসংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশে খাদ্যে আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। গম, চিনি, ভোজ্যতেল ও ডালের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কমবেশি ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায়ও দেশের খাদ্যশস্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালজুড়েই খাদ্য মূল্যস্ফীতির ওঠানামা ছিল। তবে বছরের শেষ প্রান্তে এসে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে খাদ্য, পানীয় ও তামাকের সমন্বিত মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। সেখান থেকে ক্রমে বেড়ে গত ডিসেম্বরে তা ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশে দাঁড়ায়। তাছাড়া প্রায়ই দেশের ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়াও রফতানি নিষেধাজ্ঞার হিড়িক লেগেছে। তাতে আমদানিনির্ভর দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। বাংলাদেশেও এখন খাদ্যনিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য আমদানি ও সরকারি মজুদের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের নীতিসহায়তা দেয়ার ওপর বিশেষজ্ঞরা জোর আরোপ করছে। সূত্র জানায়, দেশে প্রায় ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা থাকলেও ৭-৮ লাখ টন দেশে উৎপাদন হয়। ২৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের মধ্যে ২২-২৩ লাখ টনই আমদানিনির্ভর। ১৮-২০ লাখ টন চিনির চাহিদার প্রায় শতভাগই এখন আমদানি হচ্ছে। আর দেশে চালের চাহিদা আড়াই কোটি টনের বেশি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে হাওরে বন্যার কারণে উৎপাদন কম হওয়ায় ১৫-২০ শতাংশ চাল আমদানি করতে হবে। সূত্র আরো জানায়, বৈশ্বিক গমের বাজারের ২৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। তাছাড়া ভুট্টা উৎপাদনেও সামনের সারিতে দেশ দুটির অবস্থান। যুদ্ধের কারণে দেশ দুটি থেকে রফতানি এখন এক প্রকার বন্ধ। যুদ্ধের আগে ওই দুই দেশই ছিল বাংলাদেশের আমদানীকৃত গমের বড় উৎস। প্রতিবেশী ভারতও সম্প্রতি গম রফতানি বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য রফতানি উন্মুক্ত রেখেছে ভারত। তারপরও সংশ্লিষ্ট সবাই দীর্ঘমেয়াদে বিষয়টি নিয়ে বড় শঙ্কায় ভুগছে। তাছাড়া বৈশ্বিক ভোজ্যতেল ও ডালশস্যের বাজারেও রাশিয়া ও ইউক্রেনের বড় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যুদ্ধে ওই দুই ধরনের খাদ্যপণ্যের বাজারেও সরবরাহ চেইনে বড় ওলটপালট ঘটেছে। দেশে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। পণ্যটির শীর্ষ সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যে এক দফায় পাম অয়েল রফতানি বন্ধ ঘোষণা করলেও সম্প্রতি দেশটি রফতানি উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। তাছাড়া ইউক্রেয়-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়েও স্বস্তি নেই ভোক্তা-ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকদের। তাছাড়া চিনির ক্ষেত্রেও ব্রাজিল ও ভারত নিয়ন্ত্রিতভাবে পণ্যটি রফতানি করছে। বাংলাদেশে পণ্যটির মোট চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়। এদিকে বিশেষজ্ঞ এবং খাদ্য আমদানিকারকদের মতে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে চাইলেই বিশ্ববাজার থেকে কম দামে পণ্য ক্রয়ের চেষ্টা করা বৃথা। তার চেয়ে নিজেদের শুল্ক কাঠামোকে সরলীকরণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা সম্ভব। ভারতসহ বিভিন্ন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশগুলো শুল্ক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। পাশাপাশি অতি জরুরি নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে বন্দর ও কাস্টমস চার্জ কমানো বা মওকুফের মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের দাম অন্তত ৬ মাস স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। মূলত খাদ্যের ক্ষেত্রে দাম নিয়ন্ত্রণই মূল সমস্যা। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব স্থানীয় বাজারে পড়ে। তাছাড়া বিনিময় হারও একটি বড় সমস্যা। যে কারণে অনেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্যে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না। খাদ্যের দামে তার প্রভাব পড়ছে। তাছাড়া সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির কারণেও দাম বাড়ার অভিযোগ অহরহই উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে অবশ্যই আমদানি সময় মতো ও প্রয়োজন মতো করতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করে বাজারে চাহিদার চাপ কমানোয় উদ্যোগী হতে হবে। দরকার হলে শুল্ক সমন্বয়ের মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। এগুলোর মাধ্যমেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। মানুষ যেন কর্মসংস্থান সৃজন করে আয় করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে পারলে ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ আরেকটু কমবে। মূলত সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করবে সার্বিক পরিস্থিতি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতার কারণে বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মধ্যে পড়বে। কারণ বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির ধারা শিগগিরই পরিবর্তন হবে না। আর যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশকেও তার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।