শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪৫ অপরাহ্ন

দেশের জন্য উপযোগী হলেও \ অর্ধশতাব্দিতেও ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেই

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০২২

এফএনএস : দেশের রেলপথের জন্য ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন উপযোগী হলেও অর্ধশতাব্দিতেও তা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অথচ ৫৩ বছর আগে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন হলেই সুফল মিলবে রেল সংশ্লিষ্টরা মনে করছে। ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন কর্ডলাইন বাস্তবায়নে বেশ কয়েক বার প্রাথমিক সমীক্ষাও করা হয়। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে ওই প্রকল্পের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অপরিকল্পিত আর সুদূরপ্রসারবিহীন প্রকল্প বাস্তবায়নে সাধারণ মানুষ কোনো সুফল না পেলেও সরকারের অর্থের অপচয় হচ্ছে। দেশের পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে উন্নয়ন সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভেঙে ফেলতে হবে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত ১৩৮ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ। সেজন্য গচ্ছা যাবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া গচ্ছা গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ঢাকা-লাকসাম রুট হয়ে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে হাইস্পিড লাইন নির্মাণ সমীক্ষার ১১০ কোটি টাকা। অথচ রেলওয়ে নতুন করে আবার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। অথচ ৫৩ বছর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে কর্ডলাইন (ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন) নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সূত্র জানায়, কর্ডলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে মাত্র ২ ঘণ্টায় চলাচল করা সম্ভব। অথচ বর্তমানে ওই পথ পাড়ি দিতে ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে শুধুমাত্র আন্তঃনগর ট্রেনেই ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগছে। আর লোকাল-মেইলে লাগছে দ্বিগুণেরও বেশি সময়। বিপুল অর্থে দেশে রেলের নতুন ইঞ্জিন-কোচ আনা হলেও বর্তমানে প্রকৃত গতির চেয়ে অর্ধেকেরও কম গতি নিয়ে চলছে ট্রেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব ৩২৪ কিলোমিটার। ওই পথে ঢাকা-লাকসাম প্রায় ৯০ কিলোমিটার নতুন কর্ডলাইন নির্মাণ হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার কমে ২০৪ কিলোমিটারে দাঁড়াবে। কর্ডলাইনে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ উভয় ট্রেন চলাচল করতে পারবে। কর্ডলাইন হলে মিটারগেজে ৩ ঘণ্টা ও ব্রডগেজে মাত্র ২ ঘণ্টায় বিরামহীম ট্রেন সার্ভিস দেয়া সম্ভব হবে। অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে সদ্যনির্মিত লাইন ভেঙে নতুন করে লাইন নির্মাণেও গতি বাড়বে না। বরং ওসব অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নে দেড় থেকে দুই যুগ লেগে যেতে পারে। আর কর্ডলাইন নির্মাণ করতে সময় লাগবে সাড়ে ৩ থেকে ৪ বছর সময়। সূত্র আরো জানায়, বিগত ১৯৬৯ সালে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণে পরিকল্পনা ও সমীক্ষা সম্পন্ন হয়। তাতে বলা হয়, লাকসাম থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা পর্যন্ত কর্ডলাইন নির্মাণ হলে মাত্র ২ ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রামে ভ্রমণ সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে রেল অবকাঠামোতে চট্টগ্রাম থেকে একটি আন্তঃনগর ট্রেন কুমিল­া, লাকসাম, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, ভৈরব, নরসিংদী, টঙ্গী, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে বৃত্তাকার পথে ঘুরে ঢাকায় পৌঁছতে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইনটি নির্মাণ হলে বর্তমান গতিতে ট্রেন চললেও সময় লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টা। কর্ডলাইনে সর্বোচ্চ ১৬০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলতে পারবে। তাতে ওই দূরত্ব পার হতে ২ ঘণ্টারও কম সময় লাগবে। কর্ডলাইনের সঙ্গে লাকসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত লাইন ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন করে নিলেই হবে। যা ওই পথে চলমান লাইনকে খুব সহজে কর্ডলাইনে পরিণত করা সম্ভব। সর্বশেষ ২০০৬ সালে এসএম এএমইসি ইন্টারন্যাশনাল পিটি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণ সমীক্ষা সম্পন্ন করে। তাতে বলা হয়- ওই লাইন নির্মাণে ২৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার) ব্যয় হবে। ব্রডগেজ ডিজাইন স্পিড ১৬০ কিলোমিটার হবে। তাতে যাত্রী ও মালবাহী উভয় ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এদিকে রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তরের তৈরি একটি ছকে অনুসারে একই রুট হয়ে হাইস্পিড লাইনে চলাচল করতে মাত্র সোয়া ঘণ্টা (৭৫ মিনিট) সময় লাগবে। তবে তা নির্মাণ করতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগতে পারে। অর্থের জোগানও অনিশ্চিত। নতুন রোলিং স্টক লাগবে এবং তার মেরামত কারখানা নির্মাণ করতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড গ্যারেজের জন্য নতুন রোলিং স্টকেরও প্রয়োজন হবে। তাছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ হবে। তাছাড়া হাইস্পিড লাইনে মালবাহী ট্রেন পরিচালনা করা যাবে না। অথচ কর্ডলাইনে চলাচল করতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগবে। নির্মাণ করতে সময় লাগবে সাড়ে তিন থেকে চার বছর। এডিবি থেকে অর্থের সংস্থান হবে। বিদ্যমান রোলিং স্টক দিয়েই প্রাথমিকভাবে ট্রেন চালানো সম্ভব। ওই কারণে রোলিং স্টক মেরামত কারখানার প্রয়োজন হবে না। আর যাত্রী ও মালবাহী উভয় ট্রেন চালানো যাবে। কর্ডলাইন হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে একই ট্রেন দিয়ে ডাবল ট্রিপ দেয়া যাবে। ফলে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী পরিবহণ করা সম্ভব হবে। আর বর্তমানের চেয়ে যাত্রীদের ভাড়াও কম গুনতে হবে। তাছাড়া ওই পথে বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন চালানোও সম্ভব। কর্ডলাইনে ঘণ্টায় ১৬০ কিমি গতিতে ট্রেন চালানো যাবে। বর্তমানে ঘণ্টায় ৩৪ থেকে ৬৬ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলে। অন্যদিকে রেলওয়ের পরিকল্পনা, প্রকৌশল, বাণিজ্যিক, অবকাঠামো দপ্তর সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে নিরাপদ ও কম সময়ের মধ্যে ট্রেন চালাতে কর্ডলাইনের কোনো বিকল্প নেই। ওই রুটের টঙ্গী থেকে ভৈরব পর্যন্ত নতুন নির্মিত মিটারগেজ লাইন ভেঙে ফেলতে হবে। যা কয়েক বছর আগে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকায় তৈরি হয়েছে। রেল ওই পথেই আবার প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ডুয়েলগেজ ডাবললাইন নির্মাণে ঝুঁকছে। তার ওপর আবার ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে হাইস্পিড লাইন তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে। অথচ এত অল্প দূরত্বে হাইস্পিড লাইন পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। তাছাড়া হাইস্পিড লাইন রক্ষণাবেক্ষণে বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। ফলে ওই লাইনে টিকিটের দাম হবে বিমান ভাড়ার কাছাকাছি। অথচ কর্ডলাইন হলে বর্তমান ভাড়ার (যথাক্রমে ৯০ থেকে ১১৭৯ টাকা) চেয়ে আরো কম মূল্যে যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারবে। বর্তমানে রেল বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনছে। এ বিষয়ে বাংলাদেম রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার জানান, কর্ডলাইন নির্মাণের দিকেই আগানো হচ্ছে। তার একমাত্র কারণ ব্যয় কমিয়ে উন্নত সেবা দেয়া সম্ভব। ভাড়া কমে আসলে সাধারণ যাত্রীরাও ভ্রমণে উৎসাহিত হবে। তবে কিছু জরাজীর্ণ লাইন মেরামত, অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ পালটানোসহ বন্ধ স্টেশন চালু করতে হবে। একই বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, বর্তমান সরকার রেল উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন আনছে। সরকার রেলকে অত্যাধুনিকভাবে সাজাচ্ছে। ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইনের কোনো বিকল্প নেই। সেটি নির্মাণে বিশেষভাবে কাজ করা হচ্ছে। তবে ২০০৬ সালে যে সমীক্ষা হয়েছে তা আপডেট করা হচ্ছে। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড লাইন নির্মাণ প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ হলেও সরকার এ মুহূর্তে হাইস্পিড লাইন নির্মাণের দিকে যাচ্ছে না। কারণে তাতে ব্যয় অনেক বেশি। অর্থায়নও অনিশ্চয়। আর কর্ডলাইন নির্মাণে অর্থের জোগান পাওয়া যাবে। আরো অনেক আগেই কর্ডলাইন নির্মাণের প্রয়োজন ছিল।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com