৫-ই অক্টোবর, আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস। সারা বিশ্বে এই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়! এই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষালয়, বিশ্ববিদ্যালয় আছে; সেখানে যথেষ্ট মেধা, সুনাম ও দক্ষতার সাথে কাজ করছেন একদল শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীবৃন্দ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিবেদিত শিক্ষকবৃন্দ তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাকারিকুলাম অনুযায়ী নিজ নিজ ভাবনা দায়িত্ব শিক্ষাদান করে চলেছেন; গবেষণা, অধ্যয়ন, নিষ্ঠা ও একাগ্রচিত্তে কাজ করছেন শিক্ষকগণ, শিক্ষার্থীদের আচরণ, চিন্তা, মেধা ও মানবের উৎকর্ষতা সাধনে। কিন্তু আমাদের এই দেশ স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলেও দেশের বেসরঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারীগণ এখনও নানান বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হয়ে কঠিন দারিদ্রতায় নিমজ্জিত এবং তাঁদের জীবনযাত্রা আজ হুমকির সম্মুখিন!! শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় এসেও তাঁরা আজও ঘরে এবং বাইরে সবখানেই অবহেলিত, উপেক্ষিত ও লাঞ্ছিত!!
আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস তাঁদেরই জন্য এক বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, ও প্রতিরোধের জায়গা। বাংলাদেশ বেসরকারি এমপিও ভূক্ত ডিগ্রি কলেজের, উচ্চশিক্ষা স্তরে বেতন ও সুবিধা বঞ্চিত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মুক্তি!! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১৯৯৩ সালে সরকারি কলেজের পাশাপাশি দেশের কিছু মানসম্মত বেসরঃ কলেজও উচ্চ শিক্ষা তথা অনার্স কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। তখন পর্যন্ত কলেজে শিক্ষা বোর্ড অধীনে ইন্টার: ও জাঃবিঃ অধীনে ডিগ্রি কোর্স চালু ছিল!! তবে সরঃ কলেজের বিসিএস উত্তীর্ণ শিক্ষক প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা সম্মানে বেতন-ভাতা পান। বেসরঃ কলেজে ডিগ্রি পর্যন্ত (তখন ১ জন) ১+১= ২ জন শিক্ষকের এমপিও সুবিধা ছিল। তখনও ডিগ্রি স্তরে শিক্ষকদের একটা অংশ বঞ্চিত হচ্ছিল। আর, বেসরঃ কলেজে অনার্স স্তরে শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কিছুই ছিল না! সেখানে জাঃবিঃ কর্তৃক, এরকম বিধিতে প্রথম অনার্স চালু হলো যে শিক্ষার্থী হতে টিউশন ফিসের আয় সরকারি বেতনস্কেল অনুযায়ী ভুক্তভোগী শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন প্রদানের ব্যবস্থা। এইরুপ চুক্তির মধ্য দিয়ে অনার্স চালু হলেও নানাবিধ ও জটিলতার কারণে সেটা খুবই বাঁধাগ্রস্থ হয়!!
ধীরে ধীরে বেসরকারী কলেজে অনার্স কোর্স বৃদ্ধি পেতে থাকে; এক পর্যায়ে বেসরঃ কলেজেও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হলো!! পরে দেখা গেল, জাঃবিঃ পরিচালিত কলেজগুলিতে ডিগ্রী কোর্সকে ছাপিয়ে অনার্স মাস্টার্স স্তরে শিক্ষার্থীর জোয়ার বৃদ্ধি পেল!! আস্তে আস্তে দেশের প্রায় সকল কলেজে ডিগ্রি কোর্সের গ্রহণযোগ্যতা ও গুরুত্ব কমে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা অনার্স শিক্ষার প্রতি ঝুঁকে পড়ল। তারপরেও এসব কলেজগুলিতে (বিশেষত বেসরঃ) ডিগ্রি কোর্স চালু থাকলো; কিন্তু একজন শিক্ষকের পক্ষে তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্স পরিচালনা করা খুবই কষ্টসাধ্য। তাই ডিগ্রি শিক্ষকদের যুগপুৎ আন্দোলনের মুখে এই স্তরে আরও একজন শিক্ষক এমপিও হলেন; অর্থাৎ বেসরঃ কলেজে ইন্টার ও ডিগ্রি মিলিয়ে (০১+০২)=০৩ জন শিক্ষক এমপিও ভূক্ত হলেন। অথচ বেসরকারি কলেজে অনার্স মাস্টার্স স্তরে শিক্ষকদের বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা সরকার কোন ব্যবস্থা নিলেন না!! এই স্তরে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীগণ বছরের পর বছর ধরে প্রবল উপেক্ষা, নিগ্রহ, বৈষম্য ও বঞ্চনা করে কলেজ প্রদত্ত যৎসামান্য সম্মানী নিয়ে চরম দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস করে চলেছেন!! কিন্তু, সরকার ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ উল্লেখ আছে, “যেসব কলেজে ০৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রী কোর্স চালু আছে পর্যায়ক্রমে সেসব কলেজেও চার বছর মেয়াদী অনার্স কোর্স চালু করা হবে। এর কারণ এই যে ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামীলীগ দল সরকার গঠনের পর বিশেষত সরকার দলীয় রাজনীতিক ও সাংসদ-এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিগ্রী কলেজ হতে অনার্স কলেজের দিকে যাত্রা সূচিত হয়!! সরকারি শিক্ষা নীতিমালায় গ্রামবাংলার অজঃপাড়া গায়ের দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক দিনমজুর ও নিন্মআয়ের মানুষদের ছেলেমেয়েদের স্বল্প খরচে কাছাকাছি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার সুবিধাদি গ্রহণ করবে। সেই হিসেবে সরকারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে পরিচালিত দেশের কলেজ সমূহে উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রমকে নানাভাবে সমর্থন যোগিয়ে এসেছে!! বস্তুত, শিক্ষায় সরকারের এসকল উদারীকরণ, দরদী ও সহনশীলতা নীতির কারণে দেশের গ্রামাঞ্চলে অবস্থানরত দরিদ্র ও মেধাবী ছেলেমেয়েরা বিশেষ করে গ্রামের মেয়ে শিক্ষার্থীদের প্রভূত উপকার সাধিত হয়, তাঁরা বাড়িতে থেকেই বাবা-মাকে কাজে সহযোগিতার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে, এটিই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অনেকিছু!! সেই সময় থেকে হাঁটি হাঁটি পা’পা করে এখন পর্যন্ত অনেক বেসরকারী কলেজে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপক প্রসারতা পেয়েছে; আর দিনে দিনে নগণ্য হয়েছে ডিগ্রি কোর্স। স্বাভাবিক বিচারে যে কোর্সের প্রসারতা পায়, গুরুত্ববহ হয়, গ্রহনযোগ্যতা বাড়ে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জোয়ার তৈরি করে সেখানে সরকারের উচিত সেই কোর্স/স্তরেই আরও অর্থ বিনিয়োগ করে কাঙ্খিত উন্নয়ন ঘটিয়ে শিক্ষার উক্ত স্তরের শ্রীবৃদ্ধি করা, তাই নয় কি?
কিন্তু আমরা কী দেখছি; বেসরকারি কলেজে উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম সচল ও গতিশীল থাকলেও এই স্তরে কর্মরত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এখনো ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি!! তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে সরকারি বেতন কাঠামোর বাইরে থেকে নিজ জীবন ও তাঁদের পরিবারকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে ফেলছে! শিক্ষায় কাণ্ডারিসম আলোকবর্তিকা রুপি ও প্রাণদায়িনি শক্তিই যেখানে শিক্ষক; যারা এখনও সরকার থেকে কোনো প্রকার সুবিধাই পায়নি, যাদের দিনে দুবেলা খাবারের জন্য রীতিমতো দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করতে হয়, সেখানে তাঁদের নিকট হতে কীভাবে মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা আশা করা যায়? শিক্ষার এই স্তরে একই ভাবে সরকারি বিধিনূযায়ী বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কর্মরত শিক্ষকগণ বহুদিন ধরে তাঁদের ন্যায্য দাবি এমপিওর লক্ষ্যে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সমীপে অনেক অনুনয়-বিনয়, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে উত্থাপন, স্মারকলিপি প্রদান, সংবাদ সম্মেলন ও রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে এই ন্যার্য্য দাবির সমর্থনে লেখালেখি অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু তারপরও যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সরকার বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না; অথচ একই কলেজে ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত সরকারি বেতন কাঠামোয় এসেছে, সদ্য ডিগ্রী’র ৩য় শিক্ষক বেতনের ছাড় পেয়েছেন; তাছাড়া জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলিতে আত্তীকরণের মাধ্যমে অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকগণ নন-ক্যাডারভূক্ত হয়ে সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন! আবার বেসরঃ মাদ্রাসায় ফাজিল ও কামিল স্তরের শিক্ষকদেরকে সরকার এমপিও ভূক্ত করেছেন! অনেকগুলি নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় বেতনের স্বীকৃতি লাভ করেছে; দেশের বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার। তাহলে সারাদেশে বেসরাঃ এমপিও কলেজে বৈধভাবে কর্মরত মাত্র ৪,৫০০ জন শিক্ষকের এমপিও প্রাপ্তিতে কেন এতো টালবাহানা, কেন গড়িমসি, কেনইবা এতো দর কষাকষি? বেসরঃ কলেজে উচ্চশিক্ষার স্বীকৃতি ও কার্যক্রমের দীর্ঘ ৩১ বছরেও এই স্তরে শ্রমদাস বা সেবাদাস হিসেবে কঠিন সময় পার করা অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপনের এখনও কোনো পরিবর্তন এলো না! আজ এই আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসে, বাংলাদেশের বেসরঃ কলেজসমূহে উচ্চশিক্ষা স্তরে বিনা বেতনে শ্রমদারত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের দীর্ঘ নিপীড়ন, অবহেলা, হেনস্তা, বৈষম্য ও লাঞ্ছনার প্রতিকার চেয়ে অবিলম্বে “এমপিও” সুবিধার আওতায় এনে এই শিক্ষকদের বাকি জীবনকে শান্তি-সুখের আবাসে ভরিয়ে দিয়ে, প্রকৃত মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষক জাতিকে সম্মান আর মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এই দেশের সুধীমহলের জাগরন প্রয়োজন; প্রয়োজন দ্রুত সরকারি হস্তক্ষেপ!! কাজেই জাতি বিনির্মানের কারিগর চরম অবহেলিত ও নিষ্পেষিত শিক্ষকদের প্রতি সরকারের সুচিন্তা, ভাবনা ও বিবেক বোধের উদয় হবে,
তবেই স্বার্থকতা পাবে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অঙ্গীকার!
মিহির কুমার মন্ডল
প্রভাষক,
সাতক্ষীরা সিটি কলেজ, সাতক্ষীরা।