এফএনএস : দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের আকারে বড় ধরনের উলম্ফন ঘটেছে। বিগত দু’দশকে দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের আকার ১ হাজার ৩৪১ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। ম্যানুফ্যাকচারিং খাত দেশের অর্থনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। তবে পেছনে মূলত পোশাক খাতকে কৃতিত্ব দেয়া হয়। গত দুই দশকে ওই খাতটির উলেখযোগ্য মাত্রায় বিকাশ হয়েছে। একই সঙ্গে পোশাকবহির্ভূত অন্যান্য ভারী শিল্পও গড়ে উঠেছে। ভৌত অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে শিল্প খাত। উন্নত অর্থনীতির পথে অগ্রযাত্রার অন্যতম বড় পূর্বশর্ত হলো ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদনমুখী শিল্প খাত বড় হওয়া। বাংলাদেশও ওই পথে হাঁটছে। দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের দ্রুতগতিতে আকার বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে পাওয়া তথ্যানুযায়ী গত দুই দশকে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের আয়তনে বড় ধরনের উলম্ফন হয়েছে। শিল্পখাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী দুই দশক আগে ২০০১-০২ অর্থবছরে দেশের উৎপাদনমুখী শিল্পের মোট উৎপাদনের আকার ছিল ৯০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট উৎপাদন ১১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের প্রক্ষেপণ হলো শিল্প খাতে মোট উৎপাদনের পরিমাণ এখন ১৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ওই হিসেবে গত দুই দশকে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের আকার বেড়েছে অন্তত ১ হাজার ৩৪১ শতাংশ। মূলত পোশাক শিল্পের ওপর ভর করেই এখনো দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাত দাঁড়িয়ে আছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিল্পোদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আসছে। খাদ্য-পানীয়-তামাক, ইস্পাত, সিমেন্ট শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। পোশাকের পাশাপাশি সম্প্রসারিত হচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, কাঠ ও কাঠজাত পণ্য, ভোজ্যতেল, রাসায়নিক, প্লাস্টিক পণ্য, গ্লাস, স্টিল, সাধারণ ও ইলেকট্রনিক যন্ত্র এবং পরিবহন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন কার্যক্রমও। সূত্র জানায়, দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের টেকসই ক্রমবিকাশ নিশ্চিতে বৃহদায়তনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ভ‚মিকাও গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন খাতে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) থাকলেও তাদের অবদান অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হচ্ছে না। অর্থনীতি রূপান্তরে ভ‚মিকা থাকলেও তাদের বেশির ভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক। যা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের টেকসই বিকাশের পথে বড় অন্তরায় হয়ে উঠেছে। বিবিএসের পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বৃহৎ শিল্পসংশ্লিষ্ট। আবার ওসব শিল্পই মোট বেতন-মজুরি ও অন্যান্য ভাতার মধ্যে ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশ পরিশোধ করছে। শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাড়ে ৫০ শতাংশই ছোট প্রতিষ্ঠান। যদিও মোট মজুরিতে ওসব প্রতিষ্ঠানের অবদান মাত্র ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। তাছাড়া মোট বেতন-ভাতায় মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাড়ে ৮ শতাংশ ও ক্ষুদ্রায়তনের প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়ে ৩ শতাংশ অবদান রাখছে। স্থায়ী সম্পদের পরিমাণের দিক থেকেও বড় শিল্পগুলো এগিয়ে। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে উৎপাদনমুখী শিল্পের মোট স্থায়ী সম্পদের ৭০ শতাংশই। এর পরেই ছোট শিল্পগুলোর অবস্থান। শিল্প খাতের মোট সম্পদে ছোট শিল্পগুলোর অংশ ১৪ শতাংশ। মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে তা ১২ শতাংশ। আর ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অধীনে স্থায়ী সম্পদ রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। স্থানীয় কাঁচামালের সিংহভাগই ব্যবহার করে কুটির শিল্প, যার হার ৯৩ শতাংশ। ছোট শিল্পগুলোর ব্যবহারের হার ৮২ দশমিক ৮ শতাংশ। ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে মাঝারি শিল্প। বড় শিল্পগুলোর ব্যবহারের হার ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে বিদেশী কাঁচামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে ওই দৃশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত। উৎপাদনে বিদেশী কাঁচামালনির্ভরতা সবচেয়ে বেশি বড়দের, ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ। মাঝারি শিল্পগুলোর ক্ষেত্রে ওই হার ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। তাছাড়া উৎপাদনে ছোট শিল্পগুলোর ১৫ দশমিক ১ শতাংশ ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর ৬ দশমিক ২ শতাংশ নির্ভরতা রয়েছে। তাছাড়া মোট উৎপাদনে বৃহৎ শিল্পগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি, যার হার ৬০ শতাংশ। তার পরই সবচেয়ে বেশি অবদান ছোট শিল্পগুলোর, যার হার ২৪ শতাংশ। আর মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের যথাক্রমে ১২ ও ৪ শতাংশ। সূত্র আরো জানায়, দেশের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে বেসরকারি খাত মূল ভ‚মিকা পালন করেছে। যেসব খাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে, সেগুলোয়ও বেসরকারি খাত সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। উৎপাদনমুখী শিল্পের নিট স্থায়ী সম্পদের মধ্যে মেশিনারি ও যন্ত্রপাতির পরিমাণই বেশি, ৪৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। তারপরই ভ‚মি ও ভ‚মি উন্নয়নমূলক সম্পদের অবস্থান, ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অবকাঠামো রয়েছে ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং অন্যান্য সম্পদ ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত দুই দশকে অর্থনীতির রূপান্তরে উৎপাদনমুখী শিল্পের মূল ভ‚মিকা ছিল। ওই সময়ে উৎপাদনমুখী খাত শুধু বড়ই হয়নি, বৈচিত্র্যও এসেছে। শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। রফতানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারেও ওসব শিল্পের ভ‚মিকা বড় হয়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদনমুখী শিল্পের আকার অনেক বড় হয়েছে। উদ্যোক্তারা ক্রমেই বিনিয়োগের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে চলেছে। তাদের শিল্পোদ্যোগগুলোকে সফল করতে সহায়তা করেছে সরকারের নীতি। যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের মতো অবকাঠামোয় সরকারের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। যদিও এখন জ¦ালানি নিয়ে অনিশ্চয়তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আবার করের কাঠামোগত জটিলতার পাশাপাশি আছে করের চাপ। এসব বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে উৎপাদনমুখী শিল্প অর্থনীতি আরো অনেক সমৃদ্ধ হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এদিকে এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, দেশের অর্থনীতিতে এসএমইগুলোর অবদান অনেক বেশি হলেও তা দৃশ্যমান হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বড় একটি অংশ এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক রয়ে গেছে। একটি বড় কোম্পানি ব্যাংকের সঙ্গে সুদহার নিয়ে সমঝোতা করতে পারে কিন্তু ছোট কোম্পানি সে সুযোগ পায় না। অথচ তারাও উৎপাদন করছে, অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ব্যাংক সহযোগিতাসহ এসএমইগুলোর সার্বিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে সরকারের রাজস্ব আহরণের পরিসরও অনেক প্রসারিত হতো। অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ জানান, ম্যানুফ্যাকচারিং প্রবৃদ্ধির অধিকাংশই মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের। এসএমই বা ক্ষুদ্র-মাঝারির অবদান ততোটা বেশি না। বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে বেশি মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের প্রাধান্য। ওই কারণে বিসিআইর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে ক্ষুদ্র-মাঝারিদের বিষয়ে মনোযোগী হতে বলা হয়। বাংলাদেশে বড় শিল্পগুলোর ধরন বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, শুধু একটি শিল্পের সাপ্লাই চেইনের পর্যায়গুলোয় সব ধরনের উৎপাদন সক্ষমতা গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের বড় শিল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা তুলা থেকে সুতা তৈরির স্পিনিংয়ের কাজ করছে তারা শুধু স্পিনিংই করছে। যারা উইভিং করে তারা শুধু উইভিংই করছে। বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ধরনটা ভিন্নভাবে বড় কনগ্লোমারেটদের হাতে চলে গেছে। তার অন্যতম কারণ হলো একটি নির্দিষ্ট পণ্যের ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে টিকে থাকার যে নীতিসহায়তা সেটা নিশ্চিত করা যায়নি। এটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এটা না হলে একজনের হাতে সব চলে যাচ্ছে।