এফএনএস : দেড় যুগেও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়নি। আর সুনির্দিষ্ট মানদন্ড না থাকায় বাছাই কমিটি খেয়াল-খুশিমতো অভিযোগ নিচ্ছে। মূলত ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগই দুর্নীতি দমন কমিশনের দুর্নীতির অভিযোগ প্রাপ্তির প্রধান উৎস হচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির বেশিরভাগ অভিযোগই আমলে নেয়া হচ্ছে না। যদিও দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে মানুষ বিপুলসংখ্যক অভিযোগ দুদকে পাঠায়। তবে তা অনুসন্ধানের আমলে নেয়া হবে কিনা তা বাছাই কমিটির ইচ্ছের ওপর নির্ভরশীল। এ পরিস্থিতিতে দুর্নীতি না কমে বরং বিস্তার ঘটছে। অথচ অভিযোগই হচ্ছে দুদকের তদন্তের প্রথম ভিত্তি। মামলা রুজু, তদন্ত, ডকুমেন্ট সংগ্রহ, চার্জশিট দাখিল, বিচার ও রায় এবং রায়ের বিরুদ্ধে আপিলসহ অনেক কিছুই অভিযোগের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু অনুসন্ধান, তদন্ত এবং দুর্নীতি মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতাহীন ব্যক্তিরাই দুর্নীতি অভিযোগের বাছাই করছে। ফলে একদিকে যেমন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অনেক নিরীহ ব্যক্তির হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তেমনি অনেক বড় দুর্নীতিবাজকে অনুসন্ধান পর্যায়েই দায়মুক্তি পেয়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সূত্র জানায়, দেশে দুর্নীতির মাত্রা ক্রমবর্ধমান হলেও দুদকে ওই অনুপাতে অভিযোগ আসছে না। অথচ প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ সরকারি দফতরসহ নানা পর্যায়ে অহরহ দুর্নীতি, হয়রানির শিকার হচ্ছে। কিন্তু ওই অনুপাতে দুদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাচ্ছে না। আর দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা-ব্যবস্থা ও নেটওয়ার্ক না থাকায় দুর্নীতিবিষয়ক তথ্যের জন্য গণমাধ্যম এবং ভুক্তভোগীদের দাখিলকৃত অভিযোগের ওপরই দুদককে নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই না করে প্রাপ্ত অভিযোগগুলোর অধিকাংশই আমলে নেয়া হয় না। সংশ্লিষ্টদের মতে, অভিযোগ যদি তফসিলের মধ্যে না পড়ে, প্রাসঙ্গিক না হয় কিংবা ত্র“টিপূর্ণ হয় কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে করা হয় তাহলে বাছাইয়ে ওই অভিযোগ বাতিল হয়ে যায়। কারণ অভিযোগ তফসিলবহির্ভূত হলে দুদক ওই বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারে না। আর তফসিলভুক্ত হলে গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়। বিগত দেড় যুগে অভিযোগ বাছাইয়ের কোনো বিধি না হলেও সেক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্তে একটি মানদন্ড অনুসরণ করা হচ্ছে। কমিশন ১০ বৈশিষ্ট্যের একটি মানদন্ড তৈরি করে নিয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ বাছাইয়ের সময় যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা হয় তার মধ্যে রয়েছে- অভিযোগটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ কিনা। কাকে সম্বোধন করে অভিযোগ পাঠানো হয়েছে। অভিযোগকারীর পরিচয়, নাম-ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর যথার্থ কিনা। প্রাপ্ত অভিযোগ সুনির্দিষ্ট ও বস্তুনষ্ঠ কিনা। পক্ষ-বিপক্ষ কর্তৃক (শত্র“তাবশত) অযথা হয়রানির উদ্দেশেই অভিযোগ দেয়া হয়েছে কিনা। অভিযুক্ত ব্যক্তির দফতর, তার দাফতরিক পদমর্যাদা, বর্ণিত অপরাধ করার ক্ষমতা ও সুযোগ আছে কিনা। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময়কাল। অভিযোগের দরখাস্তে বর্ণিত অপরাধের ব্যক্তি ও অর্থ-সঙ্গতির পরিমাণ। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার স্থান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কর্তৃক অভিযোগের অনুসন্ধান/তদন্ত করা হতে পারে। তাছাড়া প্রাপ্ত অভিযোগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ ও দুর্নীতি দমন বিধিমালা-২০০৭ মোতাবেক কার্য সম্পাদন শেষে কোর্টে অপরাধ প্রমাণ করা যাবে কিনা, প্রমাণে কি পরিমাণ অর্থ, শ্রম, মেধা, সময় এবং উপকরণ প্রয়োজন হবে তা বিবেচনা করা হয়। দুদকের বাছাই কমিটির এক সময় প্রতি কার্যদিবসে বৈঠক বসলেও বর্তমানে দুই সপ্তাহ, কখনোবা এক মাস অন্তর ওই বৈঠক হচ্ছে। ফলে জমা পড়া অভিযোগ দীর্ঘসময় বাছাই ছাড়া পড়ে থাকছে। এদিকে দুদকের গ্যারেজ ভবনে বাছাই কমিটির পৃথক কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। অত্যন্ত সুরক্ষিত ওই কার্যালয়ে দুদক কর্মকর্তাদেরও প্রবেশ বারণ। তবে অভিযোগ বাছাইয়ের নামে অসদুপায় অবলম্বনের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগ বাছাই প্রক্রিয়াকে স্পর্শকাতর গণ্য করে বাছাই কক্ষকে নিñিদ্র নিরাপদ করা হলেও বাছাই প্রক্রিয়াটি আরো অস্বচ্ছ হয়ে ওঠেছে। কারণ বাছাই প্রক্রিয়াকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্বে রাখা হয়েছে। ফলে সরকারের বিভিন্ন দফতরে সংঘটিত প্রশাসনের দুর্নীতির অভিযোগগুলো কখনোই অনুসন্ধানের আসে না। বরং দুর্নীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি কমিশনে ওঠার আগেই নাই হয়ে যায়। সূত্র আরো জানায়, দুদকে কতগুলো অভিযোগ জমা পড়ল কতগুলো নিষ্পত্তি করা হলো ওই সংক্রান্ত তথ্য আগে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হতো। কিন্তু এখন তা করা হয় না। পাশাপাশি যেসব অভিযোগ অনুসন্ধান যোগ্য নয় সেগুলোর কোনো তালিকাও প্রকাশ করা হয় না। ফলে বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে। আর ওই সন্দেহ দূর করার জন্য বাছাই প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে দুদক গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ১০ হাজার ৭৬৬টি চিঠি দিয়েছে। কিন্তু ওসব অভিযোগের বিষয়ে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা দুদক কর্তৃপক্ষের তা জানা নেই। বর্তমানে অভিযোগ বাছাইয়ে একজন মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এবং একজন পরিচালকের (উপ-সচিব) নেতৃত্বে দুদকের একাধিক নিজস্ব কর্মকর্তাকে রাখা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান কমিটির কার্যকালে বিশেষত: প্রশাসন ক্যাডারের কোনো দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু নজির নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান জানান, অভিযোগ বাছাইয়ে একজন ডিজির নেতৃত্বে ৫/৭ জনের একটি কমিটি রয়েছে। কিন্তু অভিযোগে যেমন ত্র“টি থাকছে, আবার বাছাই পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ অভিযোগকারীই দুর্নীতির বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে না। আবার অনেক অভিযোগ রয়েছে দুদকের তফসিলবহির্ভূত। ফলে বেশিরভাগই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোকে দুদক গুরুত্ব দেয়। আর অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠতা না থাকার কারণে অভিযোগ মাত্রই অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।