জি এম শাহনেওয়াজ \ ঢাকা থেকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একদিনে না কি একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত হবে – এ নিয়ে ধ্রমজাল তৈরি হয়েছে। সংশয় তৈরি হয় নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে উত্থাপিত একটি বক্তব্যকে ঘিরে। এর পর রবিবার (৩১ জুলাই) টানা এগারো দিনের শেষ হওয়া রাজনৈতিক সংলাপেও এ ইস্যুটি উঠে এসেছে। তবে, ধ্রমজাল কাটেনি। কারণ সরকারি দল আওয়ামী লীগ এ ইস্যুতে সংলাপে কোন মতামত প্রকাশ না করলেও দলীয় সূত্রমতে, একদিনে সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার পক্ষে দলটি। তবে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি একাধিক দিনে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি দল জাপার মতই প্রস্তাব করেছে। ফলে ঝিমিয়ে পড়া ইস্যুটি নতুন করে চাউর হয়েছে। ইসির আগ্রহসহ কয়েকটি দল একাধিক দিনে সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে মত দিলেও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের এতে সাড়া নেই। তারা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় একাধিক দিনে করার চিন্তা করা হলে ভোটের পর ফল নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও ভোটে স্বচ্ছতা আনতে চার দিনে জাতীয় নির্বাচন করার কথা ভেবেছিল ইসি। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। সংলাপে অনেকেই একাধিক দিনে সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে প্রস্তাব পর্যালোচনায় এটি ইসির মূল্যায়নে থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে খোদ ইসির কর্মকর্তারা। কারণ বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত পরিচালিত হয়ে এসেছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার উপরে। এবারো ব্যতিক্রম হবে না এমনটাই আশঙ্কা করছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, সঠিকভাবে নির্বাচন করতে হলে কেন্দ্রওয়ারী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী দেয়া কঠিন। কারণ একদিনে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন হয় ১৫ লাখের মত জনবল। তাই রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে চারদিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে রবিবার সংলাপে বসে সিইসি নিজেই একাধিক দিনে জাতীয় নির্বাচনসহ বেশকিছু ইস্যুতে তাদের সহযোগিতা চেয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে যে সংলাপ করে এসেছি সেখানে কিছু বিষয় উঠে এসেছে। যেহেতু আপনারা সরকারে আছেন, কাজেই সেটা আপনাদের দৃষ্টিতে আনা উচিত। তিনি বলেন, অনেক পার্টি মনে করছে একদিনে নির্বাচন করা সমীচীন হবে না। এটা ভারতের মতো একাধিক দিনে হওয়া দরকার। কারণ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপ্রতুল। সিইসি বলেন, অনেকে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করতে বলেছেন। সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের দেশের জনমানুষের অনেক বেশি আস্থা আছে বলে তারা মনে করেছেন। এটা বলছি আপনাদের নলেজে আনার জন্য। আমরা এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। সব সংলাপ পর্যালোচনা করে লিখিতভাবে সিদ্ধান্ত জানাব। সংলাপের দলগুলোর প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পাঁচটি দল একাধিক দিনে ভোটগ্রহণের প্রস্তাব করেছে। দলগুলো হচ্ছে-জাতীয় পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ও ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ। তবে, ভোট এক দিনে হোক আর চার দিনে হোক সেটা নিয়ে আগ্রহ নেই বিশ্লেষকদের মধ্যে। তারা মনে করেন চার দিনে ভোট করার মতো পরিস্থিতি আমাদের দেশে নেই। এখানে চার দিনে ভোট করলে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে। তাদের যুক্তি যখন কোনো একটি বিভাগে ভোট হবে তখন ওই বিভাগে ক্ষমতাসীনরা সর্বশক্তি দিয়ে বিজয় নিজেদের করে নিতে চাইবে। ক্ষমতাসীনদের এই কর্মের প্রতিবাদ করতে গেলে অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা হামলার শিকার হতে পারেন বলেন মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাই ভোট চার দিনে না করে একদিনেই করার পক্ষে তারা। তার আগে প্রয়োজন নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফেরানো। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা ফেরাতে না পারলে কোনো পদ্ধতিই সফল নির্বাচন উপহার দেবে না। সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, একদিনে সংসদ নির্বাচন হয় বলে সবাই নিজ নিজ আসন ও প্রার্থী নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এতে সংহিসতা তুলনামূলক কম। কিন্তু একাধিক দিনে হলে অন্য আসনের বিশেষ গোষ্ঠী বা দল নতুন নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে। তাই পুরনো রেওয়াজ মেনে জাতীয় নির্বাচন করাই শ্রেয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনি ব্যবস্থায় যে অবিশ্বাসের সংস্কৃতি, এখানে এটা (চার ধাপে) সম্ভব না। আমাদের এখানে কারো ওপর কারো বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস না থাকারও যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের জনগণের ভোটের পবিত্র আমানত খেয়ানত করেছে। চার দিনে ভোট হওয়া সম্ভবপর না। একই মত দিয়েছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী এগারোটি নির্বাচন হয়েছে। ওই সময়ে সম্ভব হলে এখন কেনো নয়; এসব প্রশ্ন অবান্তর। আর সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চার দিনে নির্বাচন সম্ভব না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ওই রকম তৈরি হয়নি এখনও। ইলেকশন কমিশন এটা ম্যানেজ করতে পারবে না। সব দল চাইলেও না। আওয়ামী লীগ কী চাইবে জানি না। আমরা যখন প্রস্তাব করেছিলাম ১০০ শতাংশ দল বলেছিল না। আধাঘণ্টা দেরি হলে যেখানে মারামারি লাগে সেখানে চারদিনে নির্বাচন করে পাঁচ দিন, ছয় দিনে রেজাল্ট দেবে তাও আবার ইভিএম রেখে, আমাদের এখানে এখনও সেই ম্যাচুউরিটি আসেনি। যখন আসবে তখন এটা হতে পারে।