এফএনএস : শিক্ষা হলো জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষাখাত নড়বড়ে হলে জাঁতি কখনো সোজা হয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। কেননা, শিক্ষা হলো সুসভ্য ও সমৃদ্ধ জাঁতি গঠনের পূর্বশর্ত। যে জাঁতি যতো শিক্ষিত, সে জাঁতি ততো সুসভ্য। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া দেশগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যায় তারা সবসময় শিক্ষার সমৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত ও যুগোপযোগী করতে তাদের প্রচেষ্টার শেষ নেই। এটি স্পষ্ট যে, বিশ্ব চিরাচরিত যে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত ছিল এবং অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবী বিগত দশকগুলোতে যে অগ্রগতির ধারায় এগুচ্ছিল, কোভিড-১৯-এর কারণে ব্যাপকভাবে তার নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় শিক্ষা ব্যবস্থার ধরন ও স্বরূপ বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ক্রমশ তার আধুনিকায়ন ঘটেছে। কিন্তু কোভিড-১৯-এর কারণে যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে নতুন প্রজন্মের আগামীর স্বপ্নসৌধ নির্মাণের মূলকেন্দ্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিঘিœত হয়েছে। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৬০টিরও বেশি দেশের স্কুল বন্ধ ছিল। এতে ১০০ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় মোট শিক্ষার্থীর ৯৪ ভাগ কোনো-না-কোনোভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ৯৯ ভাগই নিম্ন বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশের শিক্ষার্থী। বর্তমান পৃথিবী এমন এক বিপর্যয়ের শিকার, যার প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পড়বে, মানবজাতির অন্তর্গত যে সম্ভাবনা রয়েছে তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, বিগত দশকগুলোর উন্নতির যে ধারা তা বাধাগ্রস্ত হবে। শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় ব্যাঘাতের কারণে শিশুদের পুষ্টিহীনতা, বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। করোনা মহামারীকালে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হয়েছে তা হলো অসংখ্য ছাত্র, বিশেষ করে ছাত্রী শিক্ষালয় থেকে ঝরে পড়েছে। জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিনের বন্ধের কারণে দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকে ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারার ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। অর্থাৎ ৩.৪২ মিলিয়ন মাধ্যমিকের এবং ২.৫০ মিলিয়ন প্রাথমিকের মিলিয়ে মোট ৫.৯২ মিলিয়ন শিক্ষার্থী এই ক্ষতির মধ্যে আছে। তবে শহর এলাকার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি হুমকির মধ্যে রয়েছে। এই শহুরে শিক্ষার্থীদের ৩০ শতাংশ বালক এবং ২৬ শতাংশ বালিকা। আবার স্কুলে দীর্ঘদিন যেতে না পারার কারণে সারা দেশে ১০ থেকে ২০ বছর বয়সের ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনস্তাত্তি¡ক চাপে ভুগছে, তবে মানসিক সমস্যার হুমকিতে রয়েছে প্রায় সব শিক্ষার্থীই। মহামারীকালে অসংখ্য মানুষ হারিয়েছে চাকরি। অনেকের কমে গেছে আয়-রোজগার। ফলে অনেক স্বচ্ছল পরিবারও অস্বচ্ছল হয়ে পড়েছে। হয়েছে দারিদ্র্যের শিকার। আর দারিদ্র্যের কারণে ৮ শতাংশ ছেলেশিশু এবং ৩ শতাংশ মেয়েশিশু সংসারের রোজগার বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিয়োজিত হয়ে পড়েছে। বেড়ে গেছে বাল্যবিয়ে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ চর্চা না থাকার কারণে তাদের পড়া ভুলে যাচ্ছে। প্রায় সবাই শিক্ষণের বড় ঘাটতি নিয়ে উপরের শ্রেণীতে উঠে পড়েছে। আর উপরের শ্রেণীতে উঠেও নতুন শিখন নিয়ে খুব একটা এগোতে পারছে না। অন্যদিকে চলমান অ্যাসাইনমেন্ট প্রক্রিয়াও বাস্তবে তেমন একটা কার্যকর প্রক্রিয়া হিসেবে শিক্ষার্থীদের পঠনে-শিখনে ভ‚মিকা রাখতে পারছে না বলে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শিক্ষার্থীরা আজ অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে এবং অত্যন্ত দুর্বল মানবসম্পদ হিসেবে বেড়ে উঠছে। কারণ তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশও সমানভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের বিপুল শিক্ষার্থীর কর্মজীবনে প্রবেশ করা আটকে আছে। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এতে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এদের একটা উলেখযোগ্য অংশ নিজেদেরকে সামাজিক অপরাধে জড়িত করে ফেলছে। বর্তমানে আলোচিত ‘কিশোর গ্যাং’ অপসংস্কৃতিকে এই হতাশাগ্রস্তরা আরো ভয়াবহতার দিকে নিয়ে গিয়েছে। এদের অপরাধে মানুষের অর্থসম্পদ যেমন হুমকিতে, তেমনি হুমকিতে পড়েছে জীবন। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন। এই দীর্ঘ বন্ধ যে, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি ডেকে এনেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ক্ষতি অপূরণীয়। শিক্ষার এই ক্ষতির অর্থনৈতিক একটি পরিসংখ্যানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলেছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে ভবিষ্যতের আয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীপ্রতি ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৮০ মার্কিন ডলার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটির ফলে বাংলাদেশের মতো দেশে ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের অভিশাপ শিক্ষাক্ষেত্রকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। এ সময়ে শহুরে ধনিক শ্রেণীর সন্তানরা সামর্থ্যরে কারণে বিভিন্ন অনলাইন পদ্ধতিতে কিছুটা হলেও তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারলেও দরিদ্র শ্রেণী ও গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে শিক্ষাঙ্গনেও বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে দীর্ঘদিন লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে একটি বিকলাঙ্গ বা দুর্বল প্রজন্ম সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। তাঁরা বলছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, করোনা মহামারী আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি বীভৎস-বিশৃঙ্খল মুখোশ উন্মোচনের পাশাপাশি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্যও সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। দেশের শিক্ষাঙ্গনের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের নিষ্ক্রিয়তা, অদূরদর্শিতা এবং অপরিপক্বতার জন্যই করোনা মহামারীতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে আজ অবধি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘খুলতে পারা’ বা ‘না পারার’ চক্রে বন্দী হয়ে আছে আমাদের দেশ। দেশের দৃষ্টি শুধুই করোনা সমাপ্তির দিকে আবদ্ধ। অথচ মহামারীর শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই বোঝা গিয়েছিল, এই মহামারী দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে। তারপরও চার কোটি শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে সুগভীর চিন্তা করে করোনাকে সাথে করেই কিভাবে শিক্ষাজীবন চালিয়ে নেয়া যায় সে বিষয়ে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। করোনাকালীন সময় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘসময় বাড়িতে অবস্থান করায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মানসিকভাবে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে শিক্ষকেরা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকবে। ফলে অভিভাবকেরা শিক্ষকদের সহযোগিতা করতে হবে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস,আন্তরিকতা ও আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। নিয়মিত পারস্পরিক শিক্ষক-অভিভাবক যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উপাদান হল শিক্ষার্থী,আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল শিক্ষক। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও অভিভাবকের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক সফলতা পেতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।