এফএনএস: নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের প্রায় ৯০ শতাংশই কোটিপতি এবং একাদশ জাতীয় সংসদের তুলনায় কোটিপতি সংসদ সদস্যের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের তথ্য উপস্থাপন ও সুজনের পর্যবেক্ষণ’ বিষয়ক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি। সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার সংবাদ সম্মেলনে পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নবনির্বাচিত ২৯৯ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৬৯ জনের বা ৮৯.৯৭ শতাংশ সংসদ সদস্যের সম্পদ কোটি টাকার উপরে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে এই হার শতকরা ৯৫.০৬ শতাংশ বা ২১২ জন। জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিতদের মধ্যে এই হার শতকরা ৯০.৯১ শতাংশ বা ১০ জন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১০০ শতাংশ বা ৩ জন এবং স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচিতদের মধ্যে এই হার ৭০.৯৬ শতাংশ বা ৪৪ জন। সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৫ লাখ টাকার কম সম্পদের মালিক রয়েছে ৯ জন বা ৩.০১ শতাংশ; সম্পদের ঘর পূরণ না করা দুজনসহ ৩.৬৭ শতাংশ বা ১১ জন। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩৬.৪৫ শতাংশ কোটিপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েছেন ৮৯.৯৬ শতাংশ। পক্ষান্তরে ২৫ লাখ টাকা ও তার কম মূল্যের সম্পদের মালিক ৪৩.৮৫ শতাংশ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েছেন ৩.৬৭ শতাংশ। স্বল্প সম্পদের অধিকারীদের নির্বাচিত হওয়ার হার যথেষ্ট কম এবং অধিক সম্পদের মালিকদের নির্বাচিত হওয়ার হার অনেক বেশি। এতে আরও বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদে কোটিপতির শতকরা হার ছিল ৮২.৩৩ শতাংশ বা ২৪৭ জন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদে এই হার ৮৯.৯ শতাংশ বা ২৬৯ জন। যা পূর্ববতী সংসদের তুলনায় ৭.৬৪ শতাংশ বেশি। এ কথা নির্দ্বি ধায় বলা যায় যে, জাতীয় সংসদে অধিক সম্পদের অধিকারীদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বাড়ছে। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সব তথ্যের মূল ভিত্তি হলো প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন হলফনামার তথ্য যাচাই-বাছাই করে না। হলফনামায় অনেক ক্ষেত্রে তথ্য গোপন এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য থাকে। যে উদ্দেশ্যে আদালত প্রার্থীদের হলফনামায় তথ্য দিতে বাধ্যতামূলক করেছিলেন, তার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে: দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ হলেও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে বলে উল্লেখ করে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, যেখানে বিকল্প থাকে না, সেখানে বিকল্প থেকে বেছে নেওয়ার বা নির্বাচনেরও কোনো সুযোগ থাকে না। তবে বিকল্প হতে হবে যথার্থ ও বিশ্বাসযোগ্য। একই সঙ্গে সত্যিকারের নির্বাচন হতে হলে অযাচিতভাবে প্রভাবিত না হয়ে তথা স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়ার সুযোগও থাকতে হবে। কিন্তু দ্বাদশ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প ছিল না। বক্তব্যে তিনি বলেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য থাকে, যার মধ্যে অন্যতম হলো, নির্বাচনী ফলাফলের অনিশ্চয়তা, ভোটারদের সামনে বিভিন্ন দল, মত ও কর্মসূচিসম্পন্ন বিকল্প প্রার্থী থাকা, সকল প্রার্থীদের জন্য সমসুযোগ, ভোটারদের প্রভাবমুক্ত হয়ে বেছে নেওয়ার সুযোগ এবং ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদলের সম্ভাবনা, সর্বজনীনতা, নির্বাচনী আইনের যথাযথ অনুসরণ। তিনি বলেন, কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি বিধান কোন দল সরকার গঠন করবে তা আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। একই ভাবে নির্বাচনে অনেক দল অংশ না নেওয়ায় সর্বজনীনতার শর্তটিও পূরণ হয়নি। সর্বজনীনতার আরেকটি শর্ত হলো, ভোটারদের অংশগ্রহণ। এ শর্তটিও পূরণ হয়নি। কারণ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৫৮ শতাংশ ভোটার এ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেনি বা করার সুযোগ পায়নি। তৃতীয়ত, নির্বাচনী আইনেরও যথাযথ অনুসরণ হয়নি। নির্বাচনে ব্যাপকভাবে আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনা ও সহিংসতা দৃশ্যমান হয়েছে। সুজন মনে করে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ হলেও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে দশম এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল একতরফা। আর দ্বিতীয়টি অংশগ্রহণমূলক হলেও নির্বাচনের মাঠ ছিল ক্ষমতাসীনদের দখলে ও ফলাফল ছিল একতরফা। ফলে দুটো বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশে যে অস্বাভাবিকতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু এবারও জনগণের সে আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। আমরা সুজনের পক্ষ থেকে গত ৪ জানুয়ারি একটি সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী সরকারকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা ভেবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলাম। পদক্ষেপসমূহের মধ্যে ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পূবেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের হলফনামায় উল্লিখিত তথ্যসমূহের সঠিকতা যাচাই ও অসত্য তথ্য প্রদানকারীদের ফলাফল বাতিল এবং সন্দেহজনক আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীপ্রদত্ত তথ্যের সঠিকতা যাচাই করা করে অসত্য তথ্য প্রদানকারীদের ফলাফল বাতিল করা ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যেই ফলাফলের গেজেট প্রকাশিত হয়েছে এবং গত ১০ জানুয়ারি নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেছেন। একইসাথে ১১ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। আমাদের আকাক্সক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনও উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে পারে। একই সাথে সংবাদ সম্মেলন থেকে নবগঠিত সরকার এবং ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে পথ অন্বেষণের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নে বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন, মানবাধিকার সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাস, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ রোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করুন। রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাসমূহের স্থায়ী সমাধানে সুদূর প্রসারী সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করুন, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা ভাবুন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্তিশালী ও দলীয়করণমুক্ত করুন, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নির্বাহী কমিটির সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা যুক্ত ছিলেন।