বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন

‘নাজাতের বার্তা নিয়ে আসে মাহে রমজান’ আলহাজ্ব প্রফেসর মো.আবু নসর

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় রবিবার, ৯ মার্চ, ২০২৫

আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহ’র নৈকট্য লাভের শুভবার্তা নিয়ে প্রতিবছর মুসলিম জাতির দুয়ারে হাজির হয় মাহে রজমান। রোজা বা রমজানের আভিধানিক অর্থ উপবাস। আরেক অর্থ জ্বালিয়ে দেয়া, পুড়িয়ে দেয়া। আর সিয়াম শব্দটি এসেছে ‘সাওম’ থেকে, যার অর্থ বিরত থাকা। রমজান মাস আমল ও ইবাদতের স্বর্ণমৌসুম। মুসলমানদের জন্য মহিমান্বিত রমজান মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার ফরজ ইবাদত। ঊষাকালের সামান্য পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সবধরণের আহার ও কামাচার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকাকে রোজা বলে। রোজা আল্লাহ তাআলার ভয় ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই। রজমান তাকওয়ার প্রশিক্ষণ। কোরআন উপলব্ধির মাস রমজান। সুস্বাস্থ্যের জন্য মাহে রমজান। রোজা ইসলামের অন্যতম মূল ভিত্তি। রোজা আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা দান করে। রোজায় পূণ্যস্নাত হওয়ার সুযোগ অবারিত। নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যই রোজা। প্রতিটি মুসলমানদের অন্ত:দর্শন আর আত্মার পরিশুদ্ধতা তথা আত্মশুদ্ধির মাস এই রমজান। পাপ বর্জনই রমজানের বড় ইবাদত। রমজান পাপমুক্তির সুবর্ণ সুযোগের মাস। রোজা পাপের প্রতিবন্ধক। আমলের উৎসবের মাস রমজান। মাহে রমজান মানুষে মানুষে সৌহার্দ রচনার ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টির মাস। রমজান ইসলামের সৌন্দর্য, সহমর্মিতা ও মানবতাবোধ জাগিয়ে তোলে। মানবতাবিরোধী যাবতীয় পাপাচার রোধে রোজা—রমজানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রমজান মানুষের মুক্তির চিরন্তন চেতনার নাম। রোজা ইবাদতের দরজা, রহমতের ফল্গুধারা ও শরীরের যাকাত। মহান আল্লাহ ঘোষনা করেছেন যে, ‘রোজা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দিবো।’ রোজা হলো মানুষের জন্য ঢালস্বরূপ। মাহে রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে সাবান মাসের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। রজব মাসে শষ্য বপন করা হয়, শাবান মাসে ক্ষেতে পানি সিঞ্চন করা হয় এবং রমজান মাসে ফসল কর্তন করা হয়। ফজিলত এবং মর্যাদার দিক দিয়ে পবিত্র রমজান মাস বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস। সবচেয়ে বরকতপূর্ণ ইবাদতের মাস। এ মাস শুধু পবিত্র কোরআন নাযিলের মাসই নয় বরং এ মাসে মহান আল্লাহ তাআলা আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতগণের জন্য একমাস রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে প্রত্যেক ইবাদতের ফজিলত বহু গুন বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই মাসেই মহান আল্লাহ তাআলা মুক্তির নির্দেশনাস্বরূপ বিশ্বের মানবজাতির ও মানবকল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিভাবক আল কোরআন নাযিল করেছেন। এ মাসেই মহান আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য উপহারস্বরূপ পবিত্র শবে কদর প্রদান করেছেন। ‘মহিমান্বিত কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’ (সুরা ক্বাদর, আয়াত—৩)। আর এ রাতেই পবিত্র আল কোরআন নাযিল করা হয়েছে। রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। অর্থাৎ আল্লাহ’র ভীতি বা আল্লাহকে ভয়কারী হওয়া। তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে নীতি, আদর্শ, নৈতিক মূল্যবোধ ও গভীর জীবনবোধ সৃষ্টি হয়। রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তিকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে হয়। এ জন্য মাহে রমজান ও তাকওয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরবী তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ আল্লাহ ভীতি, পরহেজগারী, দ্বীনদারী, ভয় করা, বিরত থাকা, আত্নশুদ্ধি, নিজেকে কোন বিপদ—আপদ বা অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা প্রভৃতি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালার ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী মানব জীবন পরিচালনা করার নামই তাকওয়া। ইসলামে তাকওয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান কোন কাজ নেই। দ্বীনের প্রাণশক্তিই হলো তাকওয়া। ইমান ও আমলের ক্ষেত্রে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি হল তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। সুতরাং ইহকালীন কল্যান ও পরলৌকিক মুক্তির জন্য মাহে রমজানে রোজাব্রত পালন করা অত্যাবশ্যক। রোজা মহান আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য লাভের অন্যতম একটি মাধ্যম। সৃষ্টির সূচনা পর্বের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। হযরত আদম (আ.) এর সময় থেকে সিয়াম সাধনা বা রোজার প্রচলন। রাসুল পাক (সা.) এর পূর্ববর্তী নবীদের আমলেও রোজা ফরজ ছিলো। আগের সব শরিয়তে রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। হযরত নূহ (আ.), হযরত দাউদ (আ.) এবং হযরত ঈসা (আ.) এর আমলেও রোজার প্রচলন ছিলো। ইঞ্জিল শরীফে দার বাদশাহ’র সময়ে বায়তুল ইলের বাসিন্দা ও বণি ইয়াহুদাদের প্রতি রোজা রাখার উল্লেখ রয়েছে। তবে মহান আল্লাহ তাআলা কাছে হযরত দাউদ (আ.) এর রোজা ছিলো উত্তম। তিঁনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন। হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহ’র কাছে তাওরত প্রাপ্তির আগে ৪০দিন পানাহার ত্যাগ করেছিলেন। হযরত ঈসা (আ.) ইঞ্জিল প্রাপ্তির আগে ৪০দিন রোজা রেখেছিলেন। হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত নূহ (আ.) পর্যন্ত চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ ‘আইয়ামে বিজ’ এর রোজা ফরজ ছিলো। উল্লেখ্য যে, নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার কারণে হযরত আদম (আ.) এর দেহের রং কালো হয়ে যায়। ফেরেশতাগণ তাঁর দেহের রং আগের মতো পরিবর্তনের জন্য মহান আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করেন। তখন আল্লাহ চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে ওহি পাঠান। আদম (আ.) ওহি অনুযায়ী রোজা রাখলেন। এতে তাঁর গায়ের রং ঊজ্জ্বল হলো। এ কারণে এই ৩ দিনকে ‘আইয়ামে বিজ’ বা ঊজ্জ্বল দিবস বলা হয়। আধ্যাত্মিক সাধনা হিসেবে রোজা বা উপবাস পৃথিবীর প্রায় সব প্রাচীন ধর্মে স্বীকৃত। যদিও প্রত্যেক ধর্মের রূপরেখা ির্ভন্ন, বিধি—বিধান ভিন্ন এবং নামও ভিন্ন। সেটা পালনের প্রেক্ষাপট এবং সময়ও ছিলো ভিন্ন। ইতিহাসে পাওয়া যায় চীন, জাপান, কোরিয়া, মিশর ও গ্রীস প্রভৃতি দেশে রোজার প্রচলন ছিলো। ইহুদিদের উপর প্রতি শনিবার ও প্রতিবছরে মহরমের ১০তারিখ আশুরার দিন ও অন্যান্য সময়েও রোজা আবশ্যক ছিলো। খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের মতো রোজা ফরজ হিসেবে পালন করতো। বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়। বেদের অনুসারী হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত অর্থাৎ উপবাসের নিয়ম আছে। সুতরাং জাতি—ধর্ম নির্বিশেষে সবার মধ্যে রোজা পালনের প্রমান পাওয়া যায়। নাম, নিয়মকানুন, ধারণ—প্রক্রিয়া ও সময়ের ভিন্নতা থাকলেও মানবজাতির আত্মশুদ্ধির জন্য আদিম যুগ থেকেই অনেক গৌত্র, বর্ণ, সম্প্রদায় ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রোজার প্রচলন ছিলো। দুনিয়ার প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) রোজা রাখার পদ্ধতি চালু করেন। হযরত নূহ (আ.) এর যুগেও প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালনের বিধান ছিলো। উল্লেখ্য যে, মাসে ৩দিন রোজা রাখার বিধান হযরত নূহ (আ.) এর যুগ থেকে শুরু করে রাসুল (সা.) এর যুগ পর্যন্ত কার্যকর ছিলো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিলো। অত:পর দ্বিতীয় হিজরীতে রমজান মাসজুড়ে রোজা পালন ফরজ হিসেবে আরোপিত হলে পূর্বের তা রহিত হয়ে যায়। মুমিনের প্রতি রমজানের পাঁচটি গুণাবলী প্রযোজ্য হয়ে থাকে। যেমন— ১. তাকওয়া অর্জন করা যায় (আল্লাহ ভীতি), ২. পাপমুক্ত হওয়া যায়, ৩. শারীরিক সামর্থ বৃদ্ধি পায়, ৪. মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় ও ৫. প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। প্রিয় নবী (সা.) বলেন— ‘রমজানের প্রথম অংশ রহমত বা দয়া, করুণা, মাঝের অংশ মাগফিরাত বা ক্ষমা ও শেষাংশ নাজাত বা মুক্তি। নাজাতের বার্তা নিয়েই আসে মাহে রমজান। একবার মহান আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা (আ.) কে বললেন— ‘আমি উম্মতে মুহাম্মাদীকে দুইটি নূর দান করেছি, যেন দু’টি অন্ধকার তাঁর জন্য পরিষ্কার হয়।’ অর্থাৎ অন্ধকার দু’টি যেনো ক্ষতিকর না হয়। দু’টি নূর হলো— নুরুল রামাদান ও নুরুল কোরআন। অন্ধকার দু’টি হলো— কবরের অন্ধকার ও কেয়ামতের অন্ধকার। উল্লেখ্য যে, হযরত জিব্রাঈল (আ.) রমজানে প্রত্যেক রাতে রাসুল (সা.)কে কোরআন পাঠ করে শোনাতেন। হুজুর পাঠ করতেন আবার জিব্রাঈলও শুনতেন। রমজানকে আল্লাহ বিষ্ময়কর এবং অসাধারণ বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল করেছেন। মানবজাতির আত্মিক উন্নতি, কল্যাণ সাধন ও সংশোধনের লক্ষ্যে আল্লাহ যুগে যুগে আসমানি গ্রন্থ রমজান মাসেই নাযিল করেছেন। ১লা রমজানে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর উপর সহিফা (অসম্পূর্ণ), ৬ই রমজানে হযরত মুসা (আ.) এর উপর তাওরাত, ১২ই রমজানে হযরত দাউদ (আ.) এর উপর যবুর, ১৩/১৮ই রমজানে হযরত ঈসা (আ.) এর উপর ইঞ্জিল এবং রমজান মাসের শবে কদরে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উপর আল কোরআন নাযিল হয়। পবিত্র কোরআন নাযিল হওয়ার কারণেই রমজানের এতো মাহত্ম। মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোন মাস আসেনি এবং মোনাফেকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। মুমিনগণ এ মাসেই শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। রমজানে বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় আর দোযখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে জিঞ্জিরাবদ্ধ করে রাখা হয়। রোজা জাহান্নাম থেকে বাঁচার অবলম্বন। সিয়াম সাধনার দ্বারা রোজাদার পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার সৌকর্যে অভিষিক্ত হন। আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম, উদারতা, ত্যাগ—তিতিক্ষা, বদাণ্যতা, মহানুভবতা ও মানবিক গুণাবলীর শিক্ষা দ্বারা রোজাদাররা উদ্ভাসিত হন। মহান আল্লাহ তাআলা ইবাদতের বসন্তকাল রমজান মাসে সর্বোত্তম আমল যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমাদের তৌফিক দান করুন। তাই রোজা এক মাসের আর শিক্ষা বারো মাসের। সীমিত রোজার পরে অসীম রোজা। রমজান মাস বিদায় নিবে কিন্তু সিয়াম সাধনা শেষ হবে না। বরং রমজানের পর থেকে শুরু হবে দীর্ঘকালীন সিয়াম। লেখক: আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা। সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা। মোবা: ০১৭১৭—০৮৪৭৯৩

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com