এফএনএস : নানা শর্তে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৬ শতাংশ হারে শুল্ক—কর তথা রাজস্ব আদায় বাড়াতে বলছে। যদিও গত ২০২৩—২৪ অর্থবছরে জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় বাড়ানোর শর্ত ছিল। কিন্তু ওই লক্ষ্য এনবিআর অর্জন করতে পারেনি। এ বছরও লক্ষ্য অর্জন না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ রকম অবস্থায়ই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এনবিআরের পক্ষ থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ রাখার অনুরোধ করা হলেও তা মানতে রাজি হয়নি সংস্থঅটি। উল্টো রাজস্ব আদায় বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর শর্তেই অনড় সংস্থাটি। অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দাতা সংস্থা আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় এনবিআরকে নানা ধরনের শর্ত দিয়েছে। বাকি শর্তগুলো পূরণের অগ্রগতি থাকলেও এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারছে না। গত ২০২৩—২৪ অর্থবছরে এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইবাসের হিসাব অনুসারে ওই সময় এনবিআর আদায় করেছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে পার্থক্য ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই পার্থক্যের কারণে দুই সংস্থার কর—জিডিপির অনুপাতের হিসাবেও ব্যবধান দেখা যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, কর—জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও এনবিআরের হিসাবে তা সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি। আইএমএফের প্রতিনিধিরা দুই সংস্থার হিসাবের তারতম্য নিয়ে আলোচনা করেছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখন থেকে একটি সমন্বিত হিসাব চূড়ান্ত করা হবে। সূত্র জানায়, দাতা সংস্থাটি গত কয়েক দশকে দেয়া কর অব্যাহতি বাতিলের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে। সংস্থাটির বলছে ২০২৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে তিন ধাপে বিদ্যমান সব ধরনের করছাড় বাতিল করতে হবে। এছাড়া আয়কর আইনের ৭৬ (১) ধারা বাতিলের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দেয়ার স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা বাতিলের শর্ত মানতে হবে। গত পাঁচ দশকে সরকারের পক্ষ থেকে ২০০—এর বেশি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভিন্ন খাতকে করছাড় দেয়া হয়েছে। এখন আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে এনবিআর একটি কমিটি গঠন করেছে। আয়কর ও শুল্ক খাতে কত ছাড় দেয়া হয়েছে তা নিয়ে এনবিআর দুটি আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে গত ২০২০—২১ অর্থবছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেয়া হয়েছিল। ২০২২—২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে শুল্কছাড় দেয়া হয় প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। তবে ভ্যাটছাড়ের হিসাব করেনি ভ্যাট বিভাগ। কিন্তুদেশে একটি একক হারে ভ্যাট আদায়ের পক্ষে আইএমএফ। এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ বর্তমানে শূন্য থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত একাধিক হারে ভ্যাট আদায় করে। সূত্র আরো জানায়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব রাজস্ব আদায়ে পড়েছে। চলতি ২০২৪—২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই—অক্টোবর) রাজস্ব আদায়ে ৩০ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। গত জুলাই—অক্টোবর সময়ে সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক—কর আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে দাতা সংস্থা আইএমএফের শর্ত থাকা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াবে না। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা আইএমএফকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সিস্টেম লস কমানো, দরকষাকষির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে এলএনজি কেনা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লোকসান কমানোর পরিকল্পনা করছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এখন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যাবে না। তাহলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু আইএমএফের পক্ষ থেকে চতুর্থ কিস্তি দেয়ার আগে ঋণ কর্মসূচির শর্ত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া হয়। বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে দেয়ার শর্ত। বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি খাতে ১৯ হাজার কোটি এবং বিদ্যুৎ খাতে ৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রয়েছে। গ্যাসের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৯৮ পয়সা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। আর আমদানিকৃত এলএনজির দাম বেশি হওয়ায় ভর্তুকি বেড়েছে। এলএনজি মিশ্রণের পর সরকার এখন প্রতি ঘনমিটার ৬৫ টাকায় কিনছে। তাছাড়া বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আইএমএফের প্রস্তাবও বাস্তবায়ন করছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। আইএমএফ বিদ্যুৎ খাতে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি কমাতে মূল্য সমন্বয়ের জোর দেয়। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, আইএমএফের এ মূল্যায়ন পুরোনো তথ্য—উপাত্ত নির্ভর। এখন কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমছে। অন্যদিকে বিগত সরকার অর্থনীতি সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সালের জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। বাংলাদেশের ঋণ আবেদনের ছয় মাস পর সংস্থাটি ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর দুদিন পরই ঋণের প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তিতে আসে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। চলতি বছরের জুনে তৃতীয় কিস্তিতে ছাড় হয় ১১৫ কোটি ডলার। তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিশ্রুত ঋণের মধ্যে আর বাকি আছে ২৩৯ কোটি ডলার, যা ২০২৬ সালের মধ্যে আরো চার কিস্তিতে পাওয়ার কথা। আর চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে ঋণের বিপরীতে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছিল, তা পর্যবেক্ষণ করতে আইএমএফের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। আইএমএফের শর্তের মধ্যে ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা। অন্যদিকে আইএমএফের শর্তের বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান জানান, আইএমএফ রাজস্ব আদায়ের একটি চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য দিয়েছে। তবে তা আদায় করা অসম্ভব নয়।