এফএনএস : লোকসানের ভয়ে বিভিন্ন নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে ঠিকাদাররা। মূলত নির্মাণ উপকরণের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধিই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তবে প্রতিবছর মূল্য সমন্বয় হওয়ায় মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। কিন্তু অন্যান্য নির্মাণ কাজে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে নির্মাণ উপকরণের দাম নির্ধারণ বা কোনো ধরনের নির্দেশনা না দিয়ে কাজ বাস্তবায়নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু লাভের চেয়ে বেশি লোকসানে ঠিকাদাররা হতাশ। অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ ছেড়ে দেয়ারও চিন্তা করছেন। অনেকে প্রয়োজনে কালো তালিকাভুক্তির শাস্তি মেনে নিতেও প্রস্তুত। এমন পরিস্থিতি দেশের উন্নয়ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নির্মাণ খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নির্মাণসামগ্রীর বাজার প্রায় এক বছর ধরেই অস্থির। লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে। তবে সম্প্রতি দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইট, বালু, পাথর, রড, সিমেন্ট, রেডি মিকস, বিটুমিন এবং লোহাজাতীয় সব জিনিসের দাম উপকরণভেদে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু দরপত্রের সময় নির্ধারিত দরেই ঠিকাদারদের কাজ করতে হচ্ছে। ফলে ঠিকাদারদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেয়া না হলে ঠিকাদারদের কাজ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে। তখন এ খাতে যেসব মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে তারাও ঝুঁকিতে পড়বে। সূত্র জানায়, বিগত ২০০৭ সালে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে তৎকালীন সরকার নির্মাণ উপকরণের মূল্য পুননির্ধারণ করেছিল। ফলে তখন ঠিকাদার বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল অঙ্কের আর্থিক থেকে বাঁচতে পেরেছিল। না হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণখেলাপি হয়ে পড়তো। বেশিরভাগ লোককেই পেশা ছেড়ে যেতে হতো। বর্তমানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। কারণ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ছিল ৪৫০ থেকে ৪৬০ টাকা; আর এখন তা ৫২০ থেকে ৫৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ৮ হাজার টাকার ইটের গাড়ি এখন ১২ হাজার ৫০০ টাকা, ২ হাজার ২০০ টাকার বালুর গাড়ি ২ হাজার ৭০০ টাকা, রডের টন ৬৮ হাজার টাকার স্থলে এখন ৮৮ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। তাছাড়া রেডিমিকস সিএফটি ৩৫০ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৩৮৫ টাকা, পাথরও গাড়িতে বেড়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, টনপ্রতি বিটুমিনের দাম ৪৮ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬ হাজার টাকা। শ্রমিকদের মজুরি ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা দিতে হচ্ছে। অতিমাত্রায় বেড়েছে গাড়িভাড়াও। সরকার চলতি বছরের নির্মাণ উপকরণের যে রেট প্রকাশ করেছে, বাজার মূল্য তার চেয়েও অনেক বেশি। অথচ অনেকের কাজ নেয়া রয়েছে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের রেট অনুযায়ী। আইনি জটিলতা থাকায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এ বিষয়টি সমাধানে সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরিপত্র জারি করতে পারে। নইলে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন আরো বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে। সূত্র আরো জানায়, ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রায় ৫শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজ থমকে গেছে। নির্মাণ উপকরণের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আপাতত কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলোরও একই চিত্র। ওই সংস্থার তত্ত¡াবধানে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পের কাজ সচল রাখতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ সচল রাখতে চাপ প্রয়োগ করলেও ঠিকাদাররা কাজ করছে না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), গৃণপূর্ত অধিদপ্তর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার উন্নয়ন কাজগুলোর একই চিত্র বিরাজ করছে। এদিকে ঠিকাদারদের মতে, যে হারে নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়ছে তাতে চলমান কাজগুলো শেষ করা ঠিকাদারদের জন্য কঠিন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে না। পাবলিক প্রকিউরমেন্টের বিধান অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলো চাইলেই নির্মাণ উপকরণের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্মাণ উপকরণ মূল্য সমন্বয় করে কোনো পরিপত্র জারি না করলে চলমান উন্নয়নযজ্ঞ থমকে যাবে। বিষয়গুলো ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্টদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে। সরকার ২০০৭ সালের মতো নির্মাণ উপকরণের মূল্য সমন্বয় করে নতুন মূল্য নির্ধারণের নির্দেশনা প্রদান করবে বলে ঠিকাদাররা আশাবাদী। না হলে দেশের উন্নয়ন কাজের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়বে। অন্যদিকে সরকারের প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্মাণসামগ্রীর দামের ঊর্ধ্বগতি স্থির না হওয়া পর্যন্ত সরকারের এখানে কিছু করার নেই। কারণ সরকার এখন একটা নির্ধারণ করবে কিন্তু কদিন পর সেটা আবার বেড়ে যাবে। সেজন্য বিদ্যমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। যদিও ঠিকাদারকে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে কিন্তু ঠিকাদাররা কীভাবে কাজ করবে। তারা কি তাদের বাড়ি, জায়গা-সম্পদ বিক্রি করে সব করবে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিষয়গুলো ভেবে নির্মাণসামগ্রীর একটি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে চলমান কাজগুলোর ক্ষেত্রেও তা কার্যকর হবে ওই পরিপত্রে এমন নির্দেশনা থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয় প্রতিষ্ঠান-বাংলাদেশ কনন্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক এবং এফবিসিসিআইর পরিচালক (ঠিকাদারি সংস্থাবিষয়ক) মো. জামাল উদ্দিন জানান, নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রায় ৮০ ভাগ উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে পড়েছে। বিষয়গুলো ভুক্তভোগীরা অবহিত করেছে। বিষয়টি এফবিসিসিআইর ঊর্ধ্বতন নেতাদের জানানো হয়েছে।