এফএনএস: জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বিশ্বজুড়ে পানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত পানি সমস্যা বাড়ছে। উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো শুষ্ক বালুচরে পরিণত হচ্ছে এবং দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে বাড়ছে লবণাক্ততা। এমন পরিস্থিতিতে পানি সংকট ও সমস্যা সমাধানে ১০ দফা সুপারিশ জানিয়েছে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন (পরিজা)’। গতকাল শুক্রবার বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘জীবন ও জীবিকার জন্য পানি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে সংগঠনটি এসব সুপারিশ জানায়। জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে যৌথভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে পরিজা ও মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্র। গোলটেবিল বৈঠকে পরিজার সভাপতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, দখল-ভরাট আর বর্জ্যে নদীগুলো এখন নিস্তব্ধ স্রোতহীন। দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য ও জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। দেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিরই একই দশা। তিস্তার পানির প্রবাহ ব্যাপকহারে কমে গেছে। পদ্মা এখন মৃতপ্রায়, যমুনায় পড়েছে চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী দখল, ভরাট ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিশ্বাস ফেলছে। তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ২.২ বিলিয়ন মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত এবং এদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব জনসংখ্যা ২ মিলিয়ন বাড়বে এবং বিশ্বব্যাপী পানির চাহিদা ৩০ শতাংশ বাড়বে। পরিজার তথ্য অনুসারে, দেশে ছোট-বড় ৪০৫টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের নদীগুলোর ৪৮টি সীমান্ত নদী, ১৫৭টি বারোমাসি নদী, ২৪৮টি মৌসুমি নদী। মানুষের অত্যাচারে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। পরিজার সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল বলেন, পানির সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা সম্পর্কিত। পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। একদিকে বস্তি এলাকায় হাজার হাজার মানুষ এক কলসি পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। অন্যদিকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এক চুমুক খেয়ে পুরো বোতলের পানি পেলে দেওয়া হয়। এভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার পানি অপচয় করা হচ্ছে। বৈঠকে পানি সংকট ও সমস্যা সমাধানে পরিজার পক্ষ থেকে যে-সব সুপারিশ তুলে ধরা হয়- ১. ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা বাড়ানো এবং অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ২. অপরিশোধিত শিল্পকারখানায় বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করা। ৩. ঢাকার আশপাশের নদীসহ অন্যান্য সব নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, লেক, দিঘী-পুকুর, নিম্নাঞ্চল, জলাভূমি দখল, ভরাট ও দূষণ বন্ধে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৪. নদী দূষণমুক্ত করা। নদীর পানি কৃষি ও শিল্পে এবং পরিশোধন করে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা। ৫. খরা মৌসুমে সেচ ও রাসায়নিক সার নির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে প্রকৃতি নির্ভর ধান চাষ করা। প্রকৃতি নির্ভর ধান চাষে গবেষণা জোরদার করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা। ৬. নদীর প্রবাহ ও নাব্যতা যথাযথ রাখার লক্ষ্যে নদীতে পিলার সমৃদ্ধ ব্রিজের পরিবর্তে ঝুলন্ত ব্রিজ বা টানেল নির্মাণ করা। ৭. নিরাপদ পানি নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা। ৮. শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত পানি পুনর্ব্যবহার করা। ৯. ভূগর্ভে কৃত্রিম রিচার্জ করা। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায়। ১০. ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রাপ্য ন্যায্য সম্পদ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের আরও অধিকতর টেকসই জীবনযাত্রার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন- মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের মহাসচিব মাহবুবুল হক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন, অধ্যক্ষ আকমল হোসেন প্রমুখ।