সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪৪ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

পান চাষে চাষীদের ভাগ্য বদল সাতক্ষীরার অর্থনীতিতে সুবাতাস

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় সোমবার, ৩ মার্চ, ২০২৫

এম. অবু ইদ্রিস \ ভৌগোলিক দিক দিয়ে সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত। ৩৮৫৮.৩৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলার কৃষি পণ্যের সুনাম দেশজুড়ে খ্যাত। বিশেষ করে বাগদা, গলদা চিংড়ি সহ সাদা মাছ ও কাঁচা শাকসবজি, ফলমূল দেশি চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের এসব কাঁচা পণ্যের চাহিদাও বেশ দামও ভালো। তবে জেলার প্রত্যেকটি উপজেলা বিশেষ বিশেষ কৃষি পণ্যের জন্য বিশেষ বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। আধুনিক মানসম্মত কৃশি সম্প্রসারণ এখনও গ্রাম অঞ্চলে প্রতিটি কৃষিস্তরে পৌঁছায়নি। গতানুগতিক চাষাবাদ ও কৃষি পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো আছে। যদি গ্রামীন পর্যায়ে আবাদি জমি আধুনিকায়ন করা যায় তাহলে বর্তমানে যে পরিমাণ শস্যপণ্য উৎপাদন হচ্ছে তার দ্বিগুণ শস্য পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। এটা সম্ভব হলে কৃষিক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে বিস্তর কাজের সুযোগ। এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও দূরীকরণ হবে গ্রামীণ বেকার সমস্যা। একদিকে বেকার সমস্যা দূরীকরণ অন্যদিকে অধিক পরিমাণ শস্য উৎপাদন জাতীয়ভাবে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এজন্য কৃষিকে দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম মেরুদন্ড বলা হয়। জেলার অঞ্চল ভেদে কৃষি পণ্যের গুণগত মান ভিন্নতা আছে। এটা নির্ভর করে মাটির উর্বরতা ও মাটির প্রকৃতি বা ধরনের উপর। বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় পান চাষে ভালো লাভবান হওয়ায় সাতক্ষীরার কৃষকদের মধ্য পান চাষে আগ্রহ বাড়ছে। শুধুমাত্র শ্যামনগর উপজেলা ব্যতীত জেলার অন্যান্য উপজেলায় পান চাষ হচ্ছে। সাতক্ষীরা সদরে ১৭ হেক্টর, কলারোয়ায় ৬০ হেক্টর, তালায় ২৫ হেক্টর, দেবহাটায় ৫ হেক্টর, কালীগঞ্জে ৩ হেক্টর জমিতে কৃষকরা পান চাষ করছেন বলে নিশ্চিত করেছেন সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ—পরিচালক (শস্য) ইকবাল আহমেদ। পান চাষী দের সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় কিনা এমন প্রশ্নের প্রতুত্তরে তিনি বলেন সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা বর্তমানে নেই তবে সিসিএপি ক্লাইমেট স্মাট প্রকল্পের আওতায় উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে নিরাপদ পান উৎপাদনের জন্য কৃষক প্রশিক্ষণ সহ প্রদর্শনী দেওয়া হচ্ছে। জেলার তালা উপজেলা সুজলা, সুফল, শস্য শ্যামলে ভরপুর। এখানকার মাটির উর্বর শক্তি ভালো হওয়ায় ফসলি জমি সবুজের চাদরে মোড়ানো। দৃষ্টিসীমা যতদূর যায় সবুজ ফসল আর ফসল। বাংলার মানুষ যে কৃষির উপর নির্ভরশীল তা এ উপজেলার কৃষি, চাষাবাদ দেখলে বোঝা যায়। এখানকার চাষিরা ধান, পান, আখ, আর শাকসবজি চাষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পানে কৃষকরা পাচ্ছে ভালো সাফল্য ফলে বেড়েছে পান চাষের পরিমাণ। আর এ পান চাষ জেলা, উপজেলা, এমনকি গ্রামীন অর্থনীতির ভিতকে মজবুত শক্তিশালী করে অর্থবহ করে তুলছে। পান অর্থকরী ফসল। পাশাপাশি ভেজস ও পুষ্টিগুণে ভরপুর এ পান পাতায় আছে এ্যন্টি ফ্লটুলেন্ট, গ্যাস্ট্র প্রটেকটিভ ও কার্মিনেটিভ এজেন্ট যার কারনে পান চিবানোর সময় মুখে স্যালাইভা তৈরি হয়। যা খাবার হজম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া পানে আছে ভিটামিন এ, নিকোটিন এসিড, থায়ামিন সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পান পাতায় বিদ্যমান। অনেকে নিয়মিত পান খান এটা অভ্যাসের বাইরে অনেক সময় নেশায় পরিণত হয়। পান রসিকরা সবসময় মুখে পান চিবাতেই ভালোবাসে। তিন বেলা খাবারের পর, সময় অসময় তাদের পানই চাই। এছাড়া আমাদের সভ্য সমাজের বিয়ের অনুষ্ঠানে পান সুপারি একটা ঐতিহ্যের অংশ বিশেষ। তাছাড়া গ্রামীন জীবনে পরিচিত বা অপরিচিত কেউ কারো বাসায় গেলে চা, পান দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এটা গ্রামীন ঐতিহ্য, রীতিনীতি, রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। পানের মান টাকার চেয়ে কম নয়। কথায় আছে পান দিয়ে মান রক্ষা করতে হয়। কোন এক দুপুরে কথা হল তালা উপজেলার অভয়তলা গ্রামের মৃত লুৎফর শেখের পুত্র পান চাষি আব্দুল কাদেরের সাথে। অল্প বয়স পিতাকে হারালে সংসারের দায়ভার তার কাধে পড়ে। মা ও তিন বোনের সংসার নিজেই সামাল দেন দিনমজুরীর মাধ্যমে। দীর্ঘ সময় তিনি অন্যের ক্ষেত, খামারে, পানের বরজে কাজ করেছেন। নিজের পানের বরজে কাজ না থাকলে একটু ফুসরত মিললেই তিনি অন্যের জমিতে কামলা দেন এখনো। দিন বদলেছে, সাথে সাথে নিজের ভাগ্যও বদলেছেন পান চাষের মাধ্যমে। নিতান্তই সহজ সরল হাস্যজ্জ্বল মুখে অতীত কষ্টের কথা ভুলে বর্তমান দিন বদলের গল্প শোনালেন তিনি দৈনিক দৃষ্টিপাত এ রিপোর্টারকে। শৈশবে পিতৃহারা চাষী এখন সমাজের অনন্য উদাহরণ। দুর্বিষহ গ্রামীণ জীবনের কষ্টের বেত্রাঘাতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এ চাষির কাছে পান চাষ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন শুকনো মৌসুম থেকে বর্ষা মৌসুম অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত সময় লাগে লত বা বীজ থেকে পরিণত গাছ হয়ে পান উঠাতে। পান চাষের জন্য প্রথমে জমির চারপাশে ভালোভাবে বেড়া দিয়ে নিতে হয় যাতে কোন প্রাণী ক্ষয়ক্ষতি না করতে পারে। এরপর মিরি করতে হয়। অর্থাৎ পানি সেচ বা নিষ্কাশনের জন্য জমির নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর হালকা মাটি কেটে সারি সারি জমি ছাড়া সামান্য উচু করে আইল দিতে হয়। আর আইলের উপরে আট থেকে দশ ইঞ্চি পরপর লত বা বীজ বপন করতে হয়। পানের বিভিন্ন জাত আছে তার মধ্য বারি১, বারি২, বারি৩, ভাবনা, সাচি, ঝাল পান সহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির। কিছুদিন পর এ বীজ থেকে তুলচী, কুশ বা কচি ডগা বাহির হলে পাটকাঠি বা শলা দিয়ে কচি ডগা ধরিয়ে দিতে হয়। এরপর আবার এই লত বা বীজের গোড়ায় মাটি উঁচু করে দিতে হয়। গাছ আরো একটু বড় হলে উপরে মাচান করে দিয়ে আবারো এর গোড়ায় মাটি দিতে হয়। এরপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা তাহলো লত বা বরজ বাধতে হয়। বেশ দক্ষতার সাথে সুনিপুণ ভাবে আইলের উপর দিয়ে পেচিয়ে পেচিয়ে করতে হয়। এ দৃশ্য দেখতে বেশ দৃষ্টিনন্দন তবে দক্ষ পান চাষি ছাড়া এটা করা সম্ভব নয়। এরপর পরিণত গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়। জাত ভেদে এর উৎপাদন কম বা বেশি হতে পারে। তবে পান চাষ বেশ সৌখিন। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পোকামাকড় কীট পতঙ্গ আক্রমণ করে পান পাতা বিনষ্ট করে। এজন্য নিয়মিত ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর কীটনাশক স্পে্র করতে হয়। সার, বিষ, পানি সেচ আর শ্রমিক তো আছেই। সব মিলিয়ে পান চাষ ব্যয়বহুল ও প্রচুর কষ্টসাধ্যের ফসল। বিঘা প্রতি পান চাষ দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। নিজের হাড় খাটা খাটুনি পরিশ্রম তো বাদ। এত বিষাদের পরেও পরিশেষে কৃষকের মুখে ফুটে তৃপ্তির হাসি যখন লভ্যাংশের মুখ দেখতে পায়। বিঘা প্রতি পান চাষ থেকে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হয় বলে জানান পান চাষী আব্দুল কাদের এভাবেই সাতক্ষীরায় পান চাষের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ভাগ্য বদলাচ্ছে। এরই সাথে সাতক্ষীরার অর্থনীতির ভিতকে মজবুত শক্তিশালী করে অর্থনীতির পালে এনে দিয়েছে সুবাতাস। তার বরজের পান স্থানীয় বাজারে পাইকারি বিক্রি করেন। একপন পানের দাম সাইজ ভেদে ১৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ একটা পানের দাম দুই থেকে তিন টাকা। চাষির বরজে দখিনা বাতাসে ফির ফির করে দোলে কচি কচি সবুজ পানের পাতা। দোলা দেয়া পাতা, পাতা তো নয় যেন এক একটা সবুজ টাকা। এ দৃশ্য দেখে কৃষকের সাদামন শীতল হয়ে চোখে মুখে ভেসে ওঠে তৃপ্তির হাসি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com