এফএনএস : প্রকৃতির ধাক্কায় এবার সঙ্কটে বোরো উৎপাদন। পাহাড়ি ঢলে এবার তলিয়ে গেছে দেশের হাওরাঞ্চলের বিপুল পরিমাণ বোরো জমি ধান। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবার চালের বাজার দরে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে শত বছরের পুরোনো দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাট ধান সঙ্কটে খাঁ খাঁ করছে। তবে সরকার এ নিয়ে চিন্তিত নয়। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে পরিমাণ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা মোট আবাদের ১ শতাংশ। তারপরও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের পরিস্থিতি বুঝে সরকার আমদানির সিদ্ধান্তের কথা বিবেচনা করবে। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, হাওরের বোরো উৎপাদন বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় অতীতেও দেশে চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৭ সালে হাওরের আগাম বন্যার কারণে চালের বাজারে জমেছিল মেঘ। তবে চাল নিয়ে বিপদ বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এখনই চাল নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। তা না হলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠতে পারে চালের বাজার। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এবার হাওরের ৭ জেলায় ৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষক, হাওরের ফসল রক্ষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, এই বোরো মৌসুমে শুধু সুনামগঞ্জেরই ৩১টি হাওরের ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। তাতে ১ লাখ ২০ হাজার টন ধান পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। আর কৃষি বিভাগের মতে ২০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্ত চাষির সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় আসানির প্রভাবে বৃষ্টিতে ধানগাছ নুইয়ে পড়া, ক্ষেতে পানি জমে ধান নষ্ট হওয়া ও ব্লাস্ট রোগের কারণে এবার বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ধান উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০ জেলায় আসানির বৃষ্টিতে ২ লাখ হেক্টর বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে। এ বছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর। তার বিপরীতে ৪৯ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরো আবাদের মাধ্যমে দেশে প্রায় ২ কোটি ৮ লাখ ৮৫ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছিল। সেজন্য ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হওয়ার কথা ছিল। তবে বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, এ সময়ে দেশে ৪৭ লাখ ৮৬ হাজার ৯৯৮ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। তাতে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৫ হাজার ২৮৩ টন চাল। ফলে ডিএই লক্ষ্যমাত্রা থেকে দেশে বোরোর আবাদ ও উৎপাদন দুটিই কমেছে। লক্ষ্যমাত্রা থেকে দেশে বোরো আবাদ কমে প্রায় ১৪ হাজার ৪০০ হেক্টর ও উৎপাদন কমেছে প্রায় ১০ লাখ টন। এ বছর দুই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন আরো কমার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের হাওর এলাকার উৎপাদিত ধান চাষির কাছে থেকে কিনে ব্যাপারিরা ভিওসি ঘাটের হাটে আনে। পূর্বাঞ্চলের শত বছরের পুরোনো বড় ধানের হাট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটে বসে। ওই হাট আশপাশের আড়াইশ’রও বেশি চালকলে ধানের জোগান দেয়। প্রতিদিন চালকলগুলোতে এক থেকে দেড় লাখ মণ ধানের চাহিদা আছে। সেখানকার চালকল থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় চাল সরবরাহ করা হয়। নতুন ধানের মৌসুমে প্রতিদিন ঘাটে ধানবোঝাই অর্ধশত নৌকা এসে নোঙর করে। তবে এবার হাটে ধানের আমদানি কম। এখন প্রতিদিন ঘাটে আসছে ১৫ থেকে ২০টি নৌকা। ওই হাটে মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ মণ ধান বেচাকেনা হতো। আর বাকি সময়গুলোতে দিনে বিক্রি হতো ৩০ থেকে ৪০ হাজার মণ ধান। এখন প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার মণ, যার অধিকাংশ অপরিপক্ক ও চোঁচাঁ (চালবিহীন)। এক বস্তা (৮০ কেজি) ধানে ১৫ থেকে ২০ কেজিই চোঁচাঁ। আর মানসম্পন্ন ধান না পাওয়ার কারণে চালকলগুলোতে সংকট তৈরি হয়েছে। ওই সঙ্কট চলতে থাকলে চালের দাম বাড়বে। এদিকে এক বছর ধরে বাজারে ৭০ টাকা কেজি দরে সরু চাল বিক্রি হচ্ছে। ওই চাল দেশের চাষিরা উৎপাদন করে। তারপরও সঙ্কট এড়াতে প্রচুর চাল আমদানি করা হয়। গত ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ১০.২৬ লাখ টন চাল মজুত ছিল। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ১১ মে পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারিভাবে ৯৮২ টন চাল আমদানি হয়েছে। তারপরও সরু চালের দাম কমেনি। সরকারি হিসাব বলছে, গত এক বছরে সরু চালের দাম কেজিতে ৪ শতাংশের বেশি (৫ টাকা) বেড়েছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ধানের বাজারদর বেশি হওয়ায় সরকারি গুদামে না দিয়ে বিভিন্ন এলাকার চাষিরা স্থানীয় বাজার ও ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করছে। ফলে এ মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে গত ২৮ এপ্রিল থেকে প্রতি কেজি ধান ২৭ টাকা এবং ৭ মে থেকে প্রতি কেজি সিদ্ধ চাল ৪০ টাকা দরে কেনা শুরু করেছে সরকার। এ সংগ্রহ অভিযান আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ বোরো ধান ২৯০ টন আর চাল ৯৬২ টন সংগ্রহ হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বোরো ধানের প্রায় ১০ শতাংশ হাওর থেকে আসে। এদেশে চাল উৎপাদনের ৬০ শতাংশই বোরো হওয়ার কারণে হাওরে বন্যার ক্ষতির বেশ প্রভাব পড়তে পারে। সর্বশেষ বৃষ্টিতেও বড় ক্ষতি হয়েছে। ফলে বোরো উৎপাদনে একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার এই হুমকি সামাল দিতে এখনই সরকারকে প্রস্তুতি নিতে হবে। হয়তো আমদানি করে সেটা সামাল দেয়া যাবে। সেজন্য নীতিনির্ধারকদের এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। বোরো ধান মে থেকে জুনের মধ্যে কাটা হয়ে যায়। আর আগস্টের মধ্যে চাষিদের কাছ থেকে বেশিরভাগ ধান ফড়িয়া, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের হাতে চলে আসে। তখন থেকেই ধান-চালের দাম বাড়তে থাকে। ফলে তখন এর সুফল চাষিরা আর পায় না। এমন পরিস্থিতিতে এখনই বর্তমানের উচ্চ শুল্কহার কমিয়ে বেসরকারি খাতকে চাল আমদানিতে উৎসাহিত করতে হবে। ২০১৭ সালে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি রহিত করেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। এদিকটি সরকারকে খেয়ালে রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব ড. নাজমানারা খানুম জানান, দেশের হাওরাঞ্চলে কী পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে সে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। বোরো ধান ও চাল আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ হবে। সংগ্রহের পরিস্থিতি দেখে প্রয়োজনে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।