জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে ॥ বাংলাদেশ অভ্যন্তরিন নৌ-পরিবহন করপোশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আয়ের উৎসসমূহের মধ্যে লাভজনক ফেরি। অথচ খুবই অবহেলায় পরিচালিত হয়ে আসছে এই যান্ত্রিক যানটি। কর্তৃপক্ষের গাঁছাড়া ভাবের কারণেই এই খাতে সৃষ্ট হয়েছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। এদিকে, – দূর্গম ও স্রোতবহমান নদীতে নৌযান দূর্ঘটনা রোধে চড়া বেতনে নিয়োগ করা হয় ইঞ্জিন কক্ষের ড্রাইভার এবং নৌ-যান পরিচালনার মাষ্টারকে। অভিযোগ রয়েছে, বেতনের সৎ ব্যবহার করেন না এ দু’জন। চড়া বেতনের আরাম-আয়াশের গরমে ফেরির স্ট্রিয়ারিং হেলপার ও ঝাঁড়ুদার হাতে তুলে দিয়ে বাসায় দিব্যি নাক ডেগে ঘুমাতে যান মাষ্টার-ড্রাইভার। ফেরি দূর্ঘটনায় পতিত হয়, যার চড়া মূল্য দিতে হয় পথ-চলতি মানুষের। অপরদিকে, অতি-মুনাফার জন্য ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করানো হয় লক্কর-ঝক্কর ফেরিতে। যারপরিপ্রেক্ষতে, -অধিক ওজনের চাপ সামলাতে না পেরে গভীর নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে ফেরি। এছাড়া হাতুড়ে নাগরিকদের হাতে স্ট্রিয়ারিং থাকায় স্রোতের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অবজ্ঞতার কারণে ঘটছে দূর্ঘটনা। এতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, – ফেরি আসলে কে চালায় ! মাষ্টার-ড্রাইভার নাকি হেলপার-ঝুাঁড়ুদার। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সর্বশেষ রজনীগন্ধা নামে একটি ফেরি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ডুবে যাওয়ার পর টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। ফেরিগুলো কারা পরিচালনা করছে নজরদারিতে আনতে ফেরি মাষ্ট্রার ও ড্রাইভারের কক্ষে বসানো হচ্ছে গোপন ক্যামেরা (সিসিটিভি)। কর্তৃপক্ষ বলছে, এতে প্রধান কার্যালয়ে বসে তদারকি করা যাবে ফেরি চলাচলের গতি-প্রকৃতি। পাশাপাশি ফেরিতে গাড়ী উঠানোর জায়গা থাকলেও ধারণ ক্ষমতাপূর্ণ হলেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে ফেরি। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে শাস্তির সম্মুখিন হবে দায়িত্বরত ফেরির কর্তা-ব্যক্তিরা। ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন যন্ত্রও বসানো হচ্ছে ফেরিতে। আর নৌ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিলম্বে হলেও ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়াতে সাধুবাদ জানায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তাদের। বলেন, শুধু সিসিটিভি বসিয়ে দায় সারলে হবে না। চালাতে হবে কঠোর নজরদারি। অপরাধ করলেই চাকরি থেকে স্থায়ী বরখাস্ত এবং শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে, তাইলেই সচেতন হবেন দায়িত্ববানরা। খবর নৌ সূত্রের। বিআইডব্লিউটিসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংস্থাটির ৭টি রুটে ফেরি চলাচল করছে ৪৩টি। চলাচলের উপযোগী ফেরির সংখ্যা ২০ থেকে ২৫টি; যেগুলো ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কেনা হয়েছে। নতুন ফেরিগুলো দুই ক্যাটাগরির; যার একটি কে টাইপ, এই ফেরিতে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ছোট-বড় ১৬টি গাড়ি নদী পার করা যাবে। আর ইউটিলিটি ক্যাটাগরিতে একসঙ্গে ১৪টি গাড়ি পার করা যাবে। এর বাইরে মান্ধাতার আমলের আরো ৫৩টির মতো ফেরি রয়েছে। সেগুলোও দেশের বিভিন্ন রুটে চলছে। ওই পুরাতন ফেরিগুলো কয়েক ক্যাটাগরির; যার মধ্যে রো রো ফেরি, স্মলফেরি, ইউটিলিটি ফেরিসহ কয়েক ধরনের রয়েছে। চলাচলরত রুটগুলো হচ্ছে, -পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দু-প্রান্তের দূরন্ত ৩ কিলোমিটার। একই ভাবে, আরিচা-কাজিরহাটের দূরত্ব ১৯ কি: মি:, শিমুলিয়া-বাংলাবাজারের ১১ কি. মি, শিমুলিয়া-কাজিরকান্দি ৯ কি. মি, হরিণাঘাট-চাঁদপুর-শরীয়তপুর ১০ কি মি, ভোলা-লক্ষ¥ীপুর-২৮ কি. মি ও লাহারহাট-ভেদুরিয়া ১০ কি. মি। এসব রুটে ফেরিগুলো চলাচল করলেও কর্তব্যরত মাষ্টার ও ড্রাইভাররা সঠিকভাবে ডিউটি করেন না। দায়সারাভাবে চলার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে ফেরির দূর্ঘটনা। কারণ অধীনস্থ কর্মচারীদের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় গিয়ে আরামে ঘুমান কিংবা দিনের অধিকাংশ সময় পারিবারিক কাজে থাকেন মগ্ন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। দূর্ঘটনা ঘটার পর অনিয়মগুলো নিয়ে শুরু হয় হইচই। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর কিছুদিন আলোচনা-সমালোচনা ও তোড়পাড় চলে। সময়ের কাল-পরিক্রমায় দূর্ঘটনায় নিহত স্বজনদের আহাজারি বন্ধ হয়ে যায়। পুরনো ধারাই ফিরে যায় ফেরির দায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিরা। টিসির বর্তমান চেয়ারম্যান অতীত-বর্তমান কর্মকান্ডগুলো যাচাই-বাছাই করে কিছু ক্রুটি নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে ফেরির ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত পণ্য-পরিবহন না করার জন্য ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে জন-সচেতনামূলক প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি ফেরির মাষ্টার ও ড্রাইভারের কক্ষে সিসি ক্যামেরা এবং ওজন নিয়ন্ত্রন যন্ত্র বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টিসির চেয়ারম্যান বলেন, ফেরি পরিচালনার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের কিছু গাফলতি রয়েছে বলে অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। আমরা ওই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার চেয়ে তাদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে বিশেষ করে মাষ্টার ও ড্রাইভার কক্ষে গোপন ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রতিটি ক্যামেরার পেছনে খরচ হতে পারে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এগুলো সঠিকভাবে স্থাপন করা সম্ভব হলে কে ফেরি চালাচেছ তা কর্মস্থলে বসেই দেখা যাবে। এর মাধ্যমে তারা স্বচ্ছতার মধ্যে চলে আসবে বলে আমি বিশ^াস করি। এদিকে, দায়িত্বরতদের অবহেলার কারণে ফেরিতে দূর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিত বিরতিতে। বিআইডবি¬উটিসির আরিচা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শীত মৌসুমে রাতে ঘন কুয়াশার মধ্যেও নির্বিঘ্নে ২০১৬ সালে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি ফেরিতে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ফগ লাইট বসানো হয়। একেকটি ৭ হাজার কিলোওয়াটের লাইট কিনতে ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। বলা হয়েছিল, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। অথচ কয়েক দিন পরই অধিকাংশ লাইট নষ্ট হয়ে যায়। এই নৌরুটের খান জাহান আলী, শাহ আলী, কেরামত আলী, ভাষা শহীদ বরকত, কপোতি, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর, শাহ আমানত ও শাহ পরান ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট বসানো হয়। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ছোট-বড় ১৬টি ফেরি চলাচল করে। এসব ফেরিত প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮শ যানবাহন পারাপার হয়। কিন্তু শীত মৌসুমে কুয়াশার কারণে প্রতিদিনই ৩ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্তও ফেরি চলাচল বন্ধ থাকছে। এসব কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে প্রায়ই ঘটছে নানা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এতে একদিকে ঘটছে প্রাণহানি, অপর দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। গত ১৭ জানুয়ারি সকালে কুয়াশায় আটকে থাকা ছোট ইউটিলিটি ফেরি ‘রজনীগন্ধা’র তলা ফেটে পানি উঠে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটের অদূরে ৯টি ট্রাক নিয়ে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া রজনীগন্ধা ফেরিটিরও ফিটনেস ছিল না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে, ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ‘আমানত শাহ’ নামের একটি ফেরি ১৭টি যানবাহন নিয়ে দৌলতদিয়া থেকে ছেড়ে পাটুরিয়ার উদ্দেশ্য গেলে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরি ঘাটের কাছে ডুবে যায়। সেই ফেরিও ফিটনেসবিহীন ছিল। ফেরিটি প্রায় ৪১ বছরের পুরাতন ছিলো। সর্বশেষ ২০১২ সালে ডকিং মেরামত হয়েছিল আমানত শাহ ফেরিটির। এরপর থেকে কোনো ফুল ডকিং করা হয়নি। এছাড়া কোনো সার্ভে সার্টিফিকেট ছিল না ফেরির। ফলে ফেরিটি চলাচলের অনুপযুক্ত ছিল। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী বলেন, ফেরির মাষ্টার ও ড্রাইভারকে নজরদারিতে রাখতে যে সিসি ক্যামেরা বসানোর চিন্তা করেছে কর্তৃপক্ষ তা ইতিবাচক। বলেন, শুধু ক্যামেরা বসিয়েই দায় সারলে চলবে না। সেগুলোর যথাযথ তদারকি রাখতে হবে। কিছু দিন পর পর পরীক্ষা করতে হবে ক্যামেরা সচল না অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কথায় আছে না, সরকারি মাল, দরিয়া কে ঢাল। এসব যেনো না হয়, সেদিকেই খেয়াল রাখতে হবে।