এফএনএস এক্সক্লুসিভ: চট্টগ্রাম বন্দরে বছরের পর বছর নিলামের অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে পণ্যভর্তি কয়েক হাজার কনটেইনার। কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের পণ্য বোঝাই ওসব কনটেইনার নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃর্পক্ষ। ওসব কনটেইনার অনেক জায়গা দখল করে রাখায় বন্দরের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া বৈদ্যুতিক ফ্রিজার কনটেইনারের (রেফার কনটেইনার) কারণে বিদ্যুৎ অপচয়ও বাড়ছে। বর্তমানে নিলামের অপেক্ষায় বন্দরের জেটিতে ৯ হাজারের বেশি কনটেইনার রয়েছে। যদিও বন্দর কতৃর্পক্ষওই বিদ্যুৎ বিলের টাকা শিপিং লাইন কোম্পানি থেকে আদায় করে। অথচ ৩০ দিনের মধ্যে কনটেইনারে থাকা পণ্য নিলাম করে কনটেইনার খালি করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। ফলে পণ্যের পাশাপাশি শিপিং লাইনগুলোকে গচ্চা দিতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নিলামের অপেক্ষঅয় চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ড এবং শেডে পণ্য বোঝাই অবস্থায় ২ হাজার ৮৩৫টি ২০ ফুট সাইজের এবং ৩ হাজার ৮০৬টি ৪০ ফুট সাইজের এফসিএল (পণ্যভর্তি) কনটেইনার বছরের পর বছর পড়ে রয়েছে। তার বাইরে ৭২ হাজার ৪৮৪ প্যাকেজ এলসিএল খোলা পণ্য এবং ৬ হাজার ৭৮৪ প্যাকেজ বাল্ক কার্গো নিলামে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী আমদানির ৩০ দিনের মধ্যে ছাড় না হওয়ায় নিলামে বিক্রির জন্য বাই পেপার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কাছে হস্তান্তর হলেও নানা জটিলতায় ওসব পণ্য নিলামে তোলা যায়নি। অথছ একটি কনটেইনার মাসে গড়ে একটি করে ভয়েস (ভাড়ায় যাওয়া) করতে পারে। ওই হিসেবে বছরে ১২টি ভয়েস করতে পারার কথা। আর তা থেকে গড়ে বছরে প্রায় ৭০ থেকে ৭২ লাখ টাকা ভাড়ায় আয় হওয়ার কথা। কিন্তু বছরের পর বছর বন্দরের ইয়ার্ডে পড়ে থাকার কারণে কনটেইনার মালিক ওই আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার যদি কনটেইনারটি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তো সবই ক্ষতি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিপিং কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা ভাড়া থেকে যেমন বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি কনটেইনারগুলো নষ্টও হয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, দেশের আমদানি—রপ্তানির ৯২ শতাংশ পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবাহিত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি এবং রপ্তানি পণ্য থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ বছরে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। বিধি অনুযায়ী কোনো পণ্য খালাসের পর ৩০ দিনের মধ্যে আমদানিকারক ডেলিভারি না নিলে তা নিলামযোগ্য হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সেগুলো নিলাম বা ধ্বংস করার এখতিয়ার চট্টগ্রাম কাস্টমসের রয়েছে। বিশে^র সব বন্দরে কনটেইনার থেকে পণ্য নামিয়ে কনটেইনার খালি করে দিলেও এদেশে ব্যতিক্রম। তাছাড়া কনটেইনার নিলামে বিক্রি না হলে পণ্য ধ্বংস করার পর কনটেইনার ভাড়া বাবদ শিপিং কোম্পানিগুলো কোনো টাকা পায় না। তবে নিলামে বিক্রি করা হলে বিক্রির একটি অংশের টাকা শিপিং কোম্পানি পেয়ে থাকে। কিন্তু নিলামের চেয়ে ধ্বংসই বেশি হয়। আর তখন উল্টো টাকা দিয়ে ধ্বংস করতে হয়। বর্তমানে ২০ ফুটের একটি কনটেইনারের বাজারমূল্য প্রায় চার লাখ টাকা ও ৪০ ফুট কনটেইনারের মূল্য ৬ লাখ টাকা। আর ২০ ফুটের একটি ফ্রিজার কনটেইনারের মূল্য ৫০ লাখ টাকা ও ৪০ ফুটের ফ্রিজার কনটেইনারের মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। ওসব কনটেইনার নষ্ট হলে শিপিং কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নষ্ট হলে একটি কনটেইনার থেকে ক্ষতি গড়ে ৬ লাখ টাকা। তাহলে ৯ হাজার কনটেইনারে ক্ষতি ৫৪০ কোটি। আবার এক বছর ভয়েস করতে না পারলে একটি কনটেইনার বঞ্চিত হচ্ছে গড়ে ৭০ লাখ টাকা। তাহলে ৯ হাজার কনটেইনার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বছরে। ১৩ বছর আটকে থাকলে ক্ষতি ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে কনটেইনারগুলো যথাসময়ে খালি করতে না পারায় মোট ৮২ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে আবার পণ্যের মূল্যও। সূত্র আরো জানায়, কনটেইনারের পণ্য নিলাম বা ধ্বংস প্রক্রিয়ায় কাজটি চট্টগ্রাম কাস্টমস করে থাকে। সাধারণত প্রথম নিলামে ভিত্তি মূল্যের ৬০ শতাংশ দাম পাওয়া না গেলে দ্বিতীয় নিলামে ওঠে। দ্বিতীয় নিলামে আবার প্রথম নিলামের সমান মূল্য পাওয়া না গেলে তৃতীয় নিলামে যেতে হয়। এভাবেই নিলাম বিলম্বিত হচ্ছে। আবার কোনো পণ্যের ওপর মামলা থাকলে তা নিলামও করা যায় না। সব মিলিয়ে কাস্টমস চাইলেও পণ্য নিলাম বা ধ্বংস করতে পারে না। আবার পণ্য সরিয়ে কনটেইনার খালি করে দিলে পণ্যটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখন পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাছাড়া ওসব পণ্য রাখার পর্যাপ্ত জায়গারও বিষয় রয়েছে। সব মিলিয়ে তা সম্ভব নয়। এদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ জানান, বছরের পর বছর কনটেইনার আটকে থাকায় শিপিং কোম্পানিগুলো এমনিতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ওপর আবার রেফার কনটেইনারের বিদ্যুৎ বিল বাড়তি বোঝা। আবার কখনো রেফার কনটেইনারগুলো দীর্ঘদিন পড়ে থাকার কারণে অকেজো হয়ে যায়। তখন তো শিপিং কোম্পানিগুলোর পুরোটাই লস। অন্যদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃর্পক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান, বন্দর কতৃর্পক্ষ নির্ধারিত সময়ের (৩০ দিন) পর কাস্টমসের কাছে পণ্যসহ কনটেইনারগুলোর ডকুমেন্টারি হস্তান্তর করে। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো বন্দরের জেটিতে রয়ে যায়। পদ্ধতিগত নানা জটিলতায় পণ্যগুলো নিলাম বা ধ্বংস প্রক্রিয়া বিলম্বের কারণে বন্দর কতৃর্পক্ষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি এর সঙ্গে জড়িত শিপিং কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্টরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।