কয়রা প্রতিনিধি \ কয়রা সদর থেকে পূর্ব দিকে ৪ নং কয়রা গ্রাম। ঐ গ্রামের পিচের রাস্তা দিয়ে কিছুদুর যেতেই রাস্তার ডান পাশে একটা বিশাল বাগান লম্বা লম্বা গাছ। চারপাশসহ উপর দিয়ে জাল দিয়ে ঢাকা। সেখানে গিয়ে দেখা যায় গ্রামে বসতভিটা ছাড়া বাকি জমিগুলো বেগুন গাছে ছেয়ে গেছে। সরেজমিনে দেখা যায় খেতে ফলন এসেছে বেগুনের। নিজের খেত থেকে বেগুন তুলছিলেন কৃষক পলাশ সরদার। কয়েকটি বেগুনেই ভরে যাচ্ছিল একটি ঝুড়ি। কারন, একেকটি বেগুনের ওজন ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম। পলাশ সরদারের খেতের একেকটি বেগুনগাছ ৫ থেকে ৬ ফুট লম্বা। প্রতিটি গাছ বলিষ্ট। চোখে না দেখলে বিশ^াস করা যায় না। একেকটি গাছে পাঁচ থেকে সাতটি বেগুন ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। একেকটি বেগুন ফুটবলের মত। চারজন শ্রমিক কাজ করছে। একই সঙ্গে স্বপ্নপূরনের আশা নিয়ে ফসল ঘরে তোলার অপেক্ষায় কয়রায় চাষিরা। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া বেগুন চাষের উপযোগী হওয়ায় বাম্পার ফলন পাচ্ছেন কৃষকরা। বাজারেও ভাল দাম পেয়ে এখন কৃষকের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। দেশি বেগুনের মতোই অটুট স্বাদ, আকারে বড়, ফলনও বেশি। পোকামাকড়ের আক্রমণও কম। সার ও কীটনাশকের প্রয়োজনীয়তাও স্বল্প। এই অল্প খরচে দ্বিগুণ উৎপাদিত হচ্ছে হাইব্রিড সানগ্রো জাতের বেগুন। ফলে ফলনশীল এ জাতের বেগুন আবাদ করে চাষিরাই হচ্ছেন লাভবান। তবে ক্রেতারাও বলছেন, যদিও এটি হাইব্রিড, তবুও এতে রয়েছে দেশি বেগুনের স্বাদ—গন্ধ। এ বেগুন উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে রাজধানীতে : কৃষকরা দৈনিক খুলনাঞ্চলকে জানান, গতবারের তুলনায় এবার বেগুনের ভাল ফলনের পাশাপাশি ভালো দামে অত্যান্ত খুশি চাষিরা। ভাল ফলনের শুধুমাত্র ধান চাষের উপর নির্ভরশীল কৃষি জমিতে বেগুন চাষ এনে দিয়েছে নতুন গতি। কৃষকদের জীবন—জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে কৃষির এই সফল বিবর্তন। এ অঞ্চলে বেগুনের চাষ বহু কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। ফলে বিভিন্ন গ্রামে দিন দিন এই বেগুনের আবাদ বাড়ছে। এই বেগুন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে খুলনা—সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা কাওরান বাজার সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বেগুন ব্যবসায়ীদের কাছে পৌছে যাচ্ছে এ অঞ্চলের রবি শস্যের আগাম অন্যতম গোল ও লম্বা বেগুন। খুলনার সর্বদক্ষিণের উপকূলীয় এলাকা কয়রার মাটি লবণাক্ত। এই লবণাক্ত জমিতে বেগুনের আবাদ কয়েক বছর আগেও ছিল কল্পনার বাইরে। সেটি এখন বাস্তবে রুপ নিয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে এ অঞ্চলের কৃষকদের প্রচেষ্টায়। এই বেগুনের চাষ কয়রার কৃষকদের জীবন জীবিকায় এখন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এক সময় এখানকার জমিতে শুধু ধান চাষই হতো। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে আলাপকালে কয়রা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষক বাম্পার ফলন পেয়েছেন। পাশাপশি দামও মিলছে সর্বোচ্চ। এতে তারা অত্যান্ত খুশি। উপজেলার ৩ নং কয়রা গ্রামের কৃষক পলাশ সরদার জানান, সর্ব প্রথমে তিনি তাঁর শশুরবাড়ী সাতক্ষীরা থেকে হাইব্রিড সানগ্রো জাতের বেগুন চাষ দেখে পছন্দ হওয়ায় কয়েকটি বেগুনের চারা নিয়ে ২০২২ সালে বাড়িতে লাগিয়েছিলেন। সেই বেগুন গাছে খুব সুন্দর বড় বড় কালো বেগুন ধরল। তখন সে মনে মনে পরিকল্পনা করল এই জাতের বেগুন প্রসেস করে যদি লাগাতে পারি তাহলে এর চেয়ে অনেক সুন্দর করতে চাষ করতে পারব। তাই কৃষক পলাশ ২০২৩ সালে পরিক্ষামূলক ১ বিঘা জায়গায় লাগিয়ে আশানুরুপ ফল পাওয়ায় এবার তিনি ২ বিঘা জমিতে এই সানগ্রো জাতের বেগুন লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, এক একটা বেগুন গাছ আমার মাথার উপরে এক হাত পর্যন্ত লম্বা। প্রত্যেকটা গাছ সুন্দর করে কাঠ দিয়ে বাঁধা আছে, যাতে গাছ ভেঙ্গে না পড়ে। একটা গাছে ৫ থেকে ৭ টা ফল সবসময় থাকে। এই ২ বিঘা জায়গায় বেগুন চাষ করতে আমর এ পর্যন্ত দেড় লক্ষ টাকার মত খরচ হয়েছে। তবে আমি গত দেড় মাসে কেনাবেচা করছি প্রায় ৩ লক্ষ টাকা। আমার বেগুন আড়তে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পাইকাররা নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করে। প্রথমে মন প্রতি ৩২০০ থেকে ৩৬০০ টাকা এখন ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকা দরে পাইকাররা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এখনও আমার বেগুন ৩ মাস উঠবে তা থেকে আমি আরও কয়েক লক্ষ টাকা কেনাবেচা করতে পারব বলে আশা করছি। একই গ্রামের কৃষক গোপাল সরদার বলেন, এই বেগুন চাষে খরচ কম লাভ বেশি। তবে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে সহযোগিতা পেলে আমরা কৃষকরা ৩নং কয়রা গ্রামকে বেগুনের গ্রাম করতে পারব। বেগুনের পাইকারি ব্যাপারি আল আমিন জানান, আমি যে সানগ্রো জাতের কালো বেগুনগুলো কিনি এ বেগুন গুলো সকালে ভোরে না আসতে পারলে পাই না। স্থানীয়ভাবে এ বেগুনগুলো কিনে প্রতিনিয়তই যখন ঢাকা কাওরান বাজার পাঠাই যতক্ষণ এই বেগুন থাকে ততক্ষণ অন্য কোন বেগুন বিক্রি হয় না। এবং এই বেগুনের এত চাহিদা যে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, আমি প্রতিদিন আমার ১ টণী গাড়ি লোড দিয়ে এই বেগুন আমি ঢাকা কাওরান বাজার সহ শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ী, চৌরাস্তা, দোহার বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠাই। এ বছর একটা গাড়ি লাগাচ্ছি, আগামী বছর এ আড়তে ২ টা গাড়ি লাগাব। উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল্যাহ আল মামুন বলেন, দক্ষিণ বঙ্গের অত্যান্ত উপকূলীয় উপজেলা কয়রা। কয়রাতে সবজি উৎপাদন অত্যান্ত চ্যালেঞ্জিং। এখানে বেশি সবজি উৎপাদিত হয় ঘেরের পাড়ে এবং বসত ভিটায়। তবে তার মধ্যে একটা সম্ভাবনাময় সবজি হচ্ছে বেগুন। এ উপজেলাতে প্রায় ৫৬ হেক্টর সবজি উৎপাদিত হয়। এ এলাকার কৃষকরা অত্যান্ত পরিশ্রমী। পাশপাশি চাষাবোদের বিভিন্ন কলাকৌশল জানার জন্য তারা কৃষি বিষয়ক সেমিনারে অংশ নিয়ে থাকেন। বেগুন চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা বেগুন চাষে উৎসাহিত হয়েছেন। আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ সহ উঠান বৈঠক ও গ্রুপ মিটিংয়ের মাধ্যমে অনুপ্রানিত করার চেষ্টা করছি। তিনি আরও বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা বেগুন চাষে অভাবনীয় বিল্পব ঘটিয়েছেন। যা দেখে অন্যান্য উপজেলার কৃষকরা উৎসাহিত হতে পারেন। কয়রার এ বেগুন ট্রেডমার্ক বা ব্র্যান্ড হিসেবে ঢাকাতে চলতেছে এবং এটাকে আরও ব্র্যান্ড করতে আমরা চেষ্টা করছি।