এফএনএস : চাপের মধ্যে বীরোচিত ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরি করলেন সিকান্দার রাজা ও রেজিস চাকাভা। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে এমন দিন সবশেষ এসেছে কবে! গ্যালারিতে ঠাসা দর্শক। নেচে-গেয়ে, হুলে−াড়ে তারা মাতিয়ে রাখলেন সারাক্ষণ। মাঠের ক্রিকেটেও সেই আবহের সুর। চরম বিপর্যয়ে কোণঠাসা অবস্থায় গিয়ে ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ে রেকর্ড গড়া অসাধারণ সেঞ্চুরি উপহার দিলেন রেজিস চাকাভা। স্বপ্নের মতো ফর্মে থাকা সিকান্দার রাজা আরেকটি দুর্দান্ত সেঞ্চুরি দলকে জিতিয়ে প্রমাণ করলেন, আগের ম্যাচের জয়টি অঘটন ছিল না! বাংলাদেশের বিপক্ষে ৯ বছর পর ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের পর এবারও সিরিজও জিতে নিল জিম্বাবুয়ে। প্রথম ম্যাচের মতো সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচেও জিম্বাবুয়ের জয় ৫ উইকেটে। আগের ম্যাচের মতো এ দিনও জিম্বাবুয়ে জিতেছে রান তাড়ায় এবং দারুণ দুটি সেঞ্চুরিতে। তার পরও দুই ম্যাচের পার্থক্য অনেক। এই ম্যাচের জয় আরও অনেক বিরোচিত এবং জিম্বাবুয়ের জন্য আরও অনেক স্মরণীয়। ২৯১ রান তাড়ায় যখন জিম্বাবুয়ে ৪ উইকেট হারায়, তাদের রান তখন ১৫ ওভারে ৪৯। জয় তো বহুদূর, টিকে থাকাই তখন মনে হচ্ছিল তাদের জন্য কঠিন। সেখান থেকে চাকাভা ও রাজার অসাধারণ জুটিতে জয়ের কাছে পৌঁছে যায় তারা। টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে ১২৭ বলে ১১৭ রানে অপরাজিত রাজা। সঙ্গে বল হাতে ৩ উইকেট নিয়ে আরও একবার তিনি ম্যান অব দা ম্যাচ। তবে এই ম্যাচের মূল ব্যাটিং নায়ক চাকাভা। ক্রেইগ আরভিনের চোটে এই সিরিজে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। যদিও পারফরম্যান্সে ছিল না নেতার প্রতিফলন। এই ম্যাচের আগে তার ওয়ানডে গড় ছিল ১৯.৮৯, স্ট্রাইক রেট ৬৪.৭৮। সেই চাকাভা বাংলাদেশকে চমকে দিলেন অবিশ্বাস্য পাল্টা আক্রমণে। ৭৩ বলের সেঞ্চুরিতে গড়লেন জিম্বাবুয়ের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড! দুজনের ম্যাচ জেতানো জুটি ১৬৯ বলে ২০১ রানের। পঞ্চম উইকেটে যা জিম্বাবুয়ের রেকর্ড। তাদের ওয়ানডে ইতিহাসেই মাত্র তৃতীয় দ্বিশতক রানের জুটি এটি। অথচ রান তাড়ার শুরুতে জিম্বাবুয়েকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন হাসান মাহমুদ। দেড় বছর পর ওয়ানডে খেলতে নামা তরুণ পেসার গতি আর লাইন-লেংথ দিয়ে নিজের প্রথম দুই ওভারেই নেন দুই উইকেট। দুই স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ ও তাইজুল ইসলাম পরে আরও দুই উইকেট নিয়ে চাপে ফেলে দেন জিম্বাবুয়েকে। তাদের রানের গতিও যায় থমকে। কিন্তু চাকাভা নামার পর বদলাতে থাকে চিত্র। পরিস্থিতি বুঝে রাজা এ দিন উইকেট আঁকড়ে রাখেন শুরুতে। জুটি জমে ওঠার পর তিনিও হাত খোলেন। সুযোগ অবশ্য দিয়েছিলেন রাজা। আগের ম্যাচে ৪৩ রানে সহজ ক্যাচ দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। এই ম্যাচে ৪২ রানে সুযোগ দিয়েছিলেন রান আউটের। মিরাজ বল ধরে স্টাম্প ভেঙেছিলেনও। কিন্তু যে হাতে বল ধরা ছিল, তিনি স্টাম্প ভাঙেন অন্য হাত দিয়ে! বেঁচে গিয়ে আবার কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেন রাজা। পেস-স্পিন কিছুই পাত্তা পায়নি দুজনের সামনে। শরিফুল ইসলাম ও তাসকিন আহমেদ ছিলেন আবারও এলোমেলো। ৫ বোলারের বাইরে অন্য কাউকে চেষ্টা করেননি অধিনায়ক। এই জুটির সময় ক্যাচ না পড়লেও ফিল্ডিংয়ে ছিল না ততটা ধার। রাজা ফিফটি স্পর্শ করেন ৬৭ বলে, চাকাভার লাগে স্রেফ ৩৬ বল। সময়ের সঙ্গে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে চোখধাঁধানো সব শট খেলতে থাকেন দুজন। ১১৫ বলে রাজা পা রাখেন পঞ্চম ওয়ানডে সেঞ্চুরিতে। ওই ওভারেই হাসান মাহমুদের বলে ছক্কায় চাকাভা পৌঁছে যান প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিতে। জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক অবশ্য কাজটা শেষ করে ফিরতে পারেননি। ১০ চার ও ২ ছক্কায় ৭৫ বলে ১০২ রান করে তিনি আউট হন মিরাজের বলে। তবে পরে তাতে একটা লাভই হয়েছে জিম্বাবুয়ের। অভিষিক্ত টনি মুনিয়োঙ্গা দেখান তার সাহস আর স্ট্রোকের ঝলক! দুটি করে চার-ছক্কায় ১৬ বলে ৩০ রানের ক্যামিও খেলেন মুনিয়োঙ্গা। ম্যাচ জিতে আবারও হুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করেন রাজা। ম্যাচের শুরুটা বাংলাদেশের জন্য ছিল দারুণ আশা জাগানিয়া। আরও একবার টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা দলকে আগ্রাসী শুরু এনে দেন তামিম ইকবাল। প্রথম ম্যাচের উইকেটেই খেলা। বাংলাদেশ অধিনয়িক এবার শুরু করেন ভিন্ন ঢঙয়ে। চোট আর বাদ দেওয়া মিলিয়ে ৫ পরিবর্তন নিয়ে একাদশ সাজায় জিম্বাবুয়ে। দলে সুযোগ পাওয়াদের একজন, অভিষিক্ত পেসার ব্র্যাড ইভান্সকে প্রথম ওভারে দুই বাইন্ডারিতে ওয়ানডে ক্রিকেটে স্বাগত জানান তামিম। এরপর তামিমের ব্যাটে বাউন্ডারির সেই ধারা চলতে থাকে প্রতি ওভারেই। প্রথম চার ওভারে চারটি বাউন্ডারির পর পঞ্চম ওভারে ইভান্সকেই দুই বাউন্ডারি ও আপার কাটে ছক্কায় বিধ্বস্ত করেন তিনি। ১০ ওভার শেষ হওয়ার আগেই ১০ চার ও ১ ছক্কায় তামিমের ফিফটি হয়ে যায় ৪৩ বলে। আরেক পাশে এনামুল হকের রান তখন ১৬ বলে ১০। একাদশ ওভারে দুটি বাউন্ডারিতে তিনিও গা ঝারা দেন। এরপরই জোড়া ধাক্কা। টানাকা চিভাঙ্গার শর্ট বলে তামিমের পুল শট আশ্রয় নেয় স্কয়ার লেগ ফিল্ডারের হাতে। চিভাঙ্গার পরের ওভারেই নাজমুল হোসেন শান্তর ড্রাইভে বোলারের হাত ছুঁয়ে বল লাগে স্টাম্পে, নন স্ট্রাইক প্রান্তে তখন ক্রিজের বাইরে এনামুল (২৫ বলে ২০)। শান্ত ও মুশফিকের রহিমের ব্যাটে সেই ধাক্কা অনেকটাই সামাল দেয় দল। বাউন্ডারির স্রোত থামলেও এক-দুই করে রান বাড়ান দুজন। জুটির ৫০ আসে ৬০ বলে। তখনও পর্যন্ত পথে থাকা দল গতি হারায় পরের সময়টাতে। প্রিয় স্লগ সুইপ খেলে টাইমিং করতে না পেরে সম্ভাবনাময় ইনিংসের অপমৃত্যু ডেকে আনেন মুশফিক (৩১ বলে ২৫)। রানের গতি কমতে থাকে পরের জুটিতে। ক্রিকেজ সময় কাটালেও শান্ত পারেননি সাবলিল ব্যাটিং করতে। মরিয়া হয়ে একবার ক্রিজ ছেড়ে বেড়িয়ে তেঁড়েফুঁড়ে শট খেলে জীবন পান ৩৪ রানে। শেষ পর্যন্ত ওয়েসলি মাধেভেরের বাড়তি লাফানো বলে তিনি আউট হন ৫৫ বলে ৩৮ করে। শান্তর ১২ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ইনিংস এটি। তবে দলের জন্য খুব কার্যকর নয়, বলতেই হবে। দেড়শর নিচে চার উইকেট হারিয়ে ফেলা দলকে এগিয়ে নেওয়ার ভার পড়ে মাহমুদউল−াহ ও আফিফ হোসেনের ওপর। সেই ভারে কিছুটা নুইয়ে পড়েন মাহমুদউল−াহ। প্রান্ত বদলাতে ধুঁকতে থাকেন তিনি। আরেক পাশে তা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন আফিফ। নিয়মিত এক-দুই নেওয়ার পাশাপাশি সুযোগ বুঝে তিনি আদায় করেন বাউন্ডারি। পরে রানের গতি একটু বাড়ান মাহমুদউল−াহও। ৮২ বলে ৮১ রানের এই জুটি থামে আফিফ হোসেনের (৪১ বলে ৪১) বিদায়ে। রাজাকে রিভার্স সুইপ খেলে উইকেট হারান তিনি। সাতে নেমে মিরাজ শুরুটা ভালো করলেও ১২ বলে ১৫ করে আউট হন রাজার বলেই। শেষ দিকে রান বাড়ানোর কাজটা করেন মাহমুদউল−াহ। পঞ্চাশে পা দেন তিনি ৬৯ বলে। ১১ ওয়ানডে ইনিংস শেষে দেখা পেলেন তিনি ফিফটির। পরে শেষ দিকে তার ব্যাট থেকে আসে তিনটি ছক্কা। অপরাজিত থাকেন তিনি ৮৪ বলে ৮০ রান করে। কিন্তু রাজা-চাকাভারা পরে দেখালেন, বিপর্যয়েরও মধ্যে কীভাবে ব্যাট করতে হয়! দলের অধিনায়কসহ প্রথম পছন্দের অন্তত ৫ জন ক্রিকেটারকে ছাড়াই স্মরণীয় জয়ে নিজেদের রাঙাল তারা অসাধারণ উজ্জীবিত পারফরম্যান্সে। সংক্ষিপ্ত স্কোর: বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৯০/৯ (তামিম ৫০, এনামুল ২০, শান্ত ৩৮, মুশফিক ২৫, মাহমুদউল্লাহ ৮০*, আফিফ ৪১, মিরাজ ১৫, তাসকিন ১, তাইজুল ৬, শরিফুল ১; ইভান্স ৭.৪-০-৬৪-০, নিয়াউচি ৮-০-৩৯-১, চিভাঙ্গা ৮.২-০-৩৯-১, রাজা ১০-০-৫৬-৩, মাধেভেরে ৯-১-৪০-২, জঙ্গুয়ে ৭-০-৪০-০)। জিম্বাবুয়ে: ৪৭.৩ ওভারে ২৯১/৫ (মারুমানি ২৫, কাইটানো ০, কাইয়া ৭, মাধেভেরে ২, রাজা ১১৭*, চাকাভা ১০২, মুনিয়োঙ্গা ৩০*; হাসান ৯-১-৪৭-২, মিরাজ ১০-০-৫০-২, শরিফুল ৯-০-৭৭-০, তাসকিন ৯-০-৬২-০,তাইজুল ১০-০-৪৮-১, আফিফ ০.৩-০-৬-০)। ফল: জিম্বাবুয়ে ৫ উইকেটে জয়ী। সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে জিম্বাবুয়ে ২-০তে এগিয়ে। ম্যান অব দা ম্যাচ: সিকান্দার রাজা।