এফএনএস এক্সক্লুসিভ: বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত বিদেশী কর্মীরা তথ্য গোপন করে নানা কৌশলে নিজ দেশে অর্থ পাচার করছে। এদেশে এনজিওগুলোয় কর্মরত বিদেশীরা বাংলাদেশি নাগরিকদের চেয়ে কম বেতন ব্যাংকিং চ্যানেলে গ্রহণ করছে এবং আয়কর বিভাগে প্রদর্শন করছে। আর প্রকৃত বেতনের বড় অংশ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অথচ নিশ্চুপ এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। একই অবস্থা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও। অভিযোগ রয়েছে, এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নিয়েই বিদেশীরা অর্থ পাচার করছে এবং কর ফাঁকি দিচ্ছে। কারণ নিয়োগের সময় তাদের বেতন কম দেখানো হয়। এদেশে কর্মরত বিদেশীরা বাংলাদেশে শুধু খরপোষ ভাতা বা জীবননির্বাহের খরচ গ্রহণ করছে— এ ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করে অনুমোদন নেয়া হয়। আর যাচাই—বাছাই ছাড়াই ব্যুরো তা মেনে নেয়। আর এ সুযোগে বাংলাদেশে কর্মরত থেকেও বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশে অর্থ না এনে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশ থেকে শুধু এনজিও বিদেশী কর্মীরাই নয়, বেসরকারি খাতে কর্মরত বিদেশীরাও একই কায়দায় কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার করছে। চলতি বছরের এপ্রিলে চীনভিত্তিক একটি কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীর বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে অর্থ পাচারের প্রমাণ পায় পুলিশের বিশেষ ব্রাঞ্চ। ওই বিদেশী কর্মীর ওয়ার্ক পারমিটে বেতন দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। আরেক ব্যক্তি টেকনিশিয়ান ভিসায় বাংলাদেশে এসে লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছে। ওয়ার্ক পারমিটে তার বেতন দেখানো হয়েছে মাত্র ৭২ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ উভয় পদেই সমশ্রেণির প্রতিষ্ঠানে একজন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশী টাকায় ৪—৫ লাখ টাকা বেতন—ভাতাদি গ্রহণ করে। সূত্র জানায়, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বিদেশীদের বাংলাদেশে কাজ করার অনুমতি দেয়। এছাড়াও এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষও (বেপজা) বিদেশীদের কাজের অনুমতি দিয়ে থাকে। সাধারণত বিদেশীদের হয়ে তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অনুমতি নিয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে কতো বিদেশী কর্মী কর্মরত সরকারি কোনো সংস্থায় তার সঠিক তথ্য নেই। এমনকি বাংলাদেশে কতো বিদেশী কর্মরত আছে বা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকে এর হালনাগাদ তথ্য এনবিআর ও সরকারি দপ্তরগুলোয়ও নেই। এনবিআরের ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী ১ লাখ ৪ হাজার ৫৬৫ জন বিদেশী করদাতা হিসাবে নিবন্ধিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত আছে কর অঞ্চল—১১তে, ৩৭ হাজার ৬৭৭ জন। এর পরের অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল—২। বিদেশির কর অঞ্চল—১১তে নিবন্ধন নেয়ার বিধান রয়েছে। প্রতিবছর কতো বিদেশি ওয়ার্ক পারমিট চেয়ে বাংলাদেশে আবেদন করেছেন, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) তার তথ্য প্রকাশ করে। তবে সংস্থাটি সর্বশেষ ২০২৩—২৪ অর্থবছরের তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি। যদিও সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ সময় দেশে কাজের অনুমোদন পাওয়া বিদেশির সংখ্যা ২০—২২ হাজারের কাছাকাছি। সংস্থাটি ২০২২—২৩ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৩০৩ জনকে, ২০২১—২২ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১২৮ জনকে এবং ২০২০—২১—এ ৮ হাজার ৭৬ জন বিদেশিকে ওয়ার্ক পারমিট দিয়েছে। সূত্র আরো জানায়, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের তথ্যমতে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা ছিলো ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭ জন। এর মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগসংক্রান্ত ভিসায় এসেছেন ১০ হাজার ৪৮৫ জন, চাকরি ভিসায় ১৪ হাজার ৩৯৯, স্টাডি ভিসায় ৬ হাজার ৮২৭ এবং ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছেন ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন। সবচেয়ে বেশি ভারতীয় নাগরিক ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে চীনের নাগরিক ১১ হাজার ৪০৪ জন। এছাড়া শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ৪৪টি দেশের নাগরিক এদেশে কাজ করছে। তারা তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়াশিল্প, চিকিৎসা সেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কাজ করছে। ৮ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের অনুরোধ জানিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, অনেক ভিনদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। যেসব বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশ অবস্থান করছেন বা কর্মরত আছেন, তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে এ বিষয়ে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেন জানান, বিদেশী এনজিওগুলো নিজস্ব অনুদানে বাংলাদেশে পরিচালিত হয়। প্রতিটি এনজিওকে কান্ট্রি ডিরেক্টর বা কান্ট্রি হেডের মতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার আগে স্থানীয় বেতন—ভাতা উল্লেখ করে অনুমোদন নিতে হয়। যা ওই ব্যক্তির আন্তর্জাতিক বেতন—ভাতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে এনজিও ব্যুরোতে ঘোষিত বেতনের ওপর আয়কর দিচ্ছে কিনা সেটাই বিবেচ্য। যদি আয়কর বিভাগে ব্যুরোতে ঘোষিত বেতনের চেয়ে কম বেতন দেখান, তবে আয়কর ফাঁকি হতে পারে। এনজিওগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতন কত হতে পারে, এর একটি মানদন্ড আছে। অন্যদিকে এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান জানান, বিদেশী কর্মীদের বাংলাদেশ ত্যাগের আগে বর্তমানে বিমানবন্দরে আয়কর সনদ যাচাই করা হয়। প্রক্রিয়াটি অটোমেশন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া কোনো বিদেশির কর ফাঁকির সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেলে এনবিআর সেটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খতিয়ে দেখবে।