স্টাফ রিপোর্টার \ বাঘ কমলে সুন্দরবন অরক্ষিত হবে। ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য। উজাড় হবে বন। হুমকির মুখে পড়বে বনের সকল প্রাণী। সম্প্রতি সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ থেকে এক দল বাঘ ভারত অংশে চলে যাওয়ার দাবী করেছে ভারতে বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মলিক। তিনি বলেন, খাদ্যের অভাবে সা¤প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ থেকে অনেক বাঘ ভারত অংশে এসেছে। এ সংখ্যা কমবেশি ১২৩। অন্তত ২৭টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরের শুমারিতে এই সংখ্যা ছিল ৯৬। তিনি বলেন, জঙ্গলে খাবারের টান ধরলেই বাঘ গ্রামে ঢুকে পড়ে। এ জন্য বাঘ নিয়ে মাস্টারপ্ল্যানের নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কড়া নির্দেশে নৌকায় করে হরিণ ও শূকর নিয়মিত গভীর জঙ্গলে ছেড়ে আসায় এই সাফল্য। অন্যদিকে ভারতের সহায়তায় সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন উজানের পানি ও মিঠা পানির সংকটে পড়ে বাঘ চলে যাচ্ছে ভারত অংশে। বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় গন্ডার সংরক্ষণ ও গন্ডার শুমারি সংক্রান্ত পুরানো আইন প্রত্যাহার বিষয়ে বলতে গিয়ে সুন্দরবনের জ্যেষ্ঠ বন কর্মকর্তা টি নারায়ণ বলেন, মানুষের টেনে দেওয়া আন্তর্জাতিক সীমারেখা প্রাণীদের জন্য কাজ করে না। শিকারের সন্ধান, খাদ্য ও যৌনসঙ্গী আছে কিনা- এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব সীমানা ঠিক করে এমন প্রাণীদের মধ্যে বাঘ অন্যতম। সঙ্গীর খোঁজে অনেক দূর পর্যন্ত পাড়ি দেয় প্রাণীটি। প্রজনন মৌসুমে সাধারণত দু’দেশের মধ্যে বাঘের ব্যাপক যাতায়াত লক্ষ্য করা যায়। বাঘের প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। গেল বছর এমন ছয়টি যাতায়াত লক্ষ্য করা গিয়েছিল। প্রজনন মৌসুমের আগেই এত বাঘ চলে আসার পেছনে কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তুলনামূলক নিরাপদ আবাসভূমি এবং খাদ্য প্রাচুর্যতার কারণেই বাংলাদেশের বাঘ ভারতের সুন্দরবনে চলে আসছে। সবশেষ শুমারি ধরলে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪। ফলে এই বনে ৩০টির মতো পুরুষ বাঘ থাকার কথা। ভারতীয় বন বিভাগের ধারণা, বাংলাদেশের বনে অস্বাভাবিকভাবে নারী বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ায় সঙ্গীর খোঁজে ভারতের অংশে আসতে পারে নিঃসঙ্গ পুরুষ বাঘগুলো। এদিকে ‘বাঘ কমে যাওয়া সুন্দরবনের বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে। তারা বলছে সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে সব সময় ঠেকিয়ে দেয় বুক চিতিয়ে। দুর্যোগ যে ক্ষত তৈরি করে তা সারিয়ে তোলে রুখে দাঁড়ায় বারবার। প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এই বন দেশের অমূল্য সম্পদ। জীবন-জীবিকার অন্যতম আধার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন থেকে গাছ কাটা, বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়া হুমকিস্বরূপ। বাঘ থাকলে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকে, কমে গাছ কাটা। কিন্তু চোরা শিকারিদের দাপটে সেই বাঘও হুমকির মুখে। ক্রমেই কমছে বাঘের সংখ্যা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত প্রাকৃতিকভাবেই সেরে ওঠে। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট ক্ষত সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় হুমকি। বন ধ্বংস মানে নিজেদের ধ্বংসের মুখে ফেলা। গত দুই বছর আগুনে সুন্দরবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। হরিণ শিকার চলছেই। পানিতে বিষ দিয়ে মাছ ধরা পরিণত হয়েছে একটি বড় সমস্যায়। এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পাশাপাশি জলজ প্রাণী ও পাখ-পাখালি হুমকির মুখে। সুন্দরবনের হুমকির কথা জানিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা বলেন, সুন্দরবনে উজান থেকে পানি আসছে। নদীতে একাধিক বাঁধ দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ, পানির যে প্রাকৃতিক ¯্রােত তা বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। লবণ পানির পরিমাণ বাড়ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। বনের ভেতরে ও আশপাশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ সরকারি-ব্যক্তিগত উদ্যোগে একাধিক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এসব স্থাপনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক লোক জনসমাগম ঘটে। এছাড়া বাঘ কমে যাওয়া সুন্দরবনের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সূত্রমতে বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে বাঘ সুরক্ষা প্রকল্প ও সুন্দরবন সুরক্ষা নামে দুটি কার্যক্রম শুরু করার কথা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে উলেখ করেছিল। এর মধ্যে ১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পটি অনুমোদন হলেও এর অর্থ বরাদ্দ হয়নি। আর ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত বাঘ সুরক্ষা প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের সভায় বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, আয়বর্ধক কোনো প্রকল্প ছাড়া নতুন কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে না। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের দিলিতে অনুষ্ঠিত বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের বাঘ সুরক্ষা কার্যক্রমের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে ভারতে বাঘের সংখ্যা দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২২৬টি করেছে। নেপাল ১০০টি থেকে বাড়িয়ে ১৯৮টি, ভুটান ৫০টি থেকে ১০৩টি করেছে। থাইল্যান্ড বাঘের সংখ্যা ৯০টি থেকে ১৮৯টি করেছে। আর চীনে বাঘের সংখ্যা সাতটি, লাওসে দুটি, ভিয়েতনামে পাঁচটিতে নেমে এসেছে। আর কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ২০০৪ সালের পায়ের ছাপ গুনে করা জরিপে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ফাঁদের মাধ্যমে করা জরিপে বাঘের সংখ্যা বেরিয়ে আসে ১০৬টি। এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আরেকটি শুমারি করে জানায়, বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। সা¤প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের বাঘ লোকালয়ে আসার প্রবনতা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, বাঘের বয়স ১২-১৩ বছর হলে তার শিকারিদাঁত পড়ে যায়। তখন হরিণ বা বন্যশূকর ধরলেও তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। তখন খাবারের সন্ধানে মাঝে মধ্যে বন-সংলগ্ন লোকালয়ে চলে যায়। আর বাঘের তাড়া খেয়ে অনেক সময় হরিণ ও বন্যশূকর লোকালয়ে চলে আসে। শূকর কচুর লতি বা এ জাতীয় খাবার পছন্দ করে। ওই খাবারের জন্যও মাঝে মধ্যে লোকালয়ে যায়। বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে জানান, সা¤প্রতিক সময়ে লোকালয়ের মধ্যে চলে এসে মানুষকে আক্রমণ করেছে এরকম ঘটনা খুব কম। বাঘের বিষয়টি হচ্ছে তারা মুভমেন্ট করে; কাছাকাছি আসতে পারে। বাঘের খাবারের সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি সে রকম দেখিনি। কারণ, বনে প্রচুর হরিণ দেখা যায়, বন্যপ্রাণী রয়েছে। পর্যটকরা যান তারাও দেখছেন। চোরাশিকারি আগেও ছিল; পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে এটা বলব না। এখন সবাই মিলে বাঘ সংরক্ষণে কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, সুন্দরবন রক্ষা চলমান প্রক্রিয়া। বন যতদিন থাকবে ততদিন সুন্দরবন রক্ষায় বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনের যে চ্যালেঞ্জ সেটি এখনো রয়ে গেছে। সুন্দরবন এলাকায় জলোচ্ছ¡াস-ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লোনা পানি বাড়ায় কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। যার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। হরিণ শিকার আগের তুলনায় কিছুটা কম হলেও আমরা একেবারে বলতে পারি না বন্ধ হয়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে বন সংরক্ষণে কাজ করে চলেছি।