জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে \ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতা (সামারি ট্রয়াল) পেতে পারেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। কমিশনের নীতি-নির্ধারকেরা এ নিয়ে শুরু করেছেন চূলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ। বিচার বিভাগ ও বিসিএস একাডেমী থেকে দক্ষ প্রশিক্ষক এনে ইসির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ইতিমধ্যে এ ধরণের উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সূত্রমতে, গণ-প্রতিনিধিত্ব আদেশের-১৯৭২ (আরপিও) দন্ডবিধির ৭২ থেকে ৮৮ এ ধারায় ইসির কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধানটি অন্তর্ভুক্ত আছে। এতোদিন প্রয়োগের অভাবে অকার্যকর ছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নিষ্কিয় আইনটি কার্যকর করার বিষয়ে ইতিবাচক চিন্তা করছেন। এখন জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় স্তরের প্রণীত আচরণ বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে। এতে উৎসাহ-প্রেরণা পাচ্ছে ইসির কর্মকর্তারা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিধানটি মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করা হলে সুবিধা কি আছে এবং অসুবিধাগুলোও কি তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিইসিসহ পাঁচ সদস্যের কমিশনের মধ্যে এ ইস্যুতে কিছুটা দ্বিধা-বিভক্ত মত উঠে এসেছে। কারণ বর্তমান কমিশনের সিইসিসহ দুজন জুডিসিয়াল সার্ভিসের, দুজন প্রশাসন সার্ভিসের এবং একজন সাবেক সেনা-কর্মকর্তা। এদিকে, বিচারিক ক্ষমতার পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কিছু কর্মকর্তাকে নির্বাচন পরিচালনার রিটার্নিং কর্মকর্তা (আরও) করার বিষয়ে সিইসির মৌন সম্মতি রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ইসির কর্মকর্তারা ৩০০ আসনের অর্ধেক দেড়শটিতে আরও হওয়ার বিষয়ে ইচ্ছাপোষণ করেছে। তবে বিচারিক ক্ষমতার মতো এটাও পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে। খবর ইসির নির্ভরশীল কর্মকর্তা সূত্রের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিতর্কমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য করতে নানামূখী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংস্কার, নিষ্কিয় আইন কার্যকর করা এবং সবাইকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে তৎপর বর্তমান এই কমিশন। খতিয়ে দেখছেন নির্বাচনের অসুবিধাগুলোকে। সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করছেন নিজেরা। চিহ্নিত করছেন প্রতিবন্ধতাগুলো। কর্মকর্তাদের যৌক্তিক মতামত ও পরামর্শসমূহ আমলে নিচ্ছেন। লক্ষ্য একটাই কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের, – বিতর্কিত ভোট আয়োজন করে তার দায় নিতে নারাজ তারা। কৌশলী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশীর বাহবা নিতে নির্বাচনের রণ-কৌশল ঠিক করে তার আলোকে অগ্রসর হতে চাইছেন তারা। কর্মকর্তারা আরপিওসহ আইনের বিধি-বিধানগুলো পড়ে শুনিয়েছেন সিইসি কমিশনারদের। যেখানে অস্পষ্টতা মনে হয়েছে; পাঠকারীতে থামিয়ে পুন: পুন: শোনার চেষ্টার করেছেন। এর আলোকে আরপিও’তে সংশোধনী এতে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, যা ভেটিং চলছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এদিকে, আরপিওর দন্ডবিধি পড়াকালিন নির্বাচনে ইসির কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতার বিষয়টি কমিশনারদের দৃষ্টিগোচর হয়। এর পর এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলে। এখন প্রস্তাবনার পর্যায়ে উঠে এসেছে স্পর্শকাতর এই ইস্যুটি। এতোদিন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটরা নির্বাচনে সামারি ট্রায়ালের মাধ্যমে আচরণ বিধি লঙ্ঘন করা সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে শান্তি ও জরিমানা দিতেন। কিন্তু এদের সংখ্যা কম। সংসদসহ স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে অফিসার সংকট দেখা দেয়। একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে অনেকগুলো এরিয়া নিয়ে কাজ করতে হয়। ফলে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করেও অনেক প্রার্থী পার পেয়ে যান। এতে বিতর্ক তৈরি হয় ওই নির্বাচন ঘিরে; বিতর্কিত হন ইসি কমিশনাররা। সিইসি এ আইনটি কার্যকর করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাবে থাকলেও কমিশনারদের মধ্যে দু-একজন কিছুটা আপত্তি তুলেছেন। তাৎক্ষণিক দায়িত্ব পেয়ে অভিজ্ঞ বিচারিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সক্ষমতা দেখাতে পারবেন কিনা এ নিয়ে সংশয়ে কেউ কেউ। ফলে কি সুবিধা ও অসুবিধা আছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, কমিশনের কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হলে সুবিধা কিছু আছে; আবার অসুবিধাও কিছু আছে। বিচার করার ক্ষেত্রে নির্বাহী এবং বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট উভয়ই অভিজ্ঞ। কারণ এই পারপাসে তাদের চাকরি। এ কাজে তাদের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। কিন্তু নির্বাচনে যত জন বিচারিক প্রয়োজন হয়; সংখ্যা অপ্রতুলতার কারণে অনেক সময় সঙ্কটে পড়ে যেতে হয়। এটা অসুবিধা। এখানে ইসির কর্মকর্তাদের দক্ষ করে তোলা গেলে ওই সঙ্কট কেটে সুবিধা পাওয়া যাবে। আবার ইসির কর্মকর্তাদের দু-একদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হলে অনভিজ্ঞতা ও চর্চার অভাবে নির্বাচনে এমন ভুল করে ফেললো, দেখা যাবে – পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঘিরেই বিতর্ক তৈরি হতে পারে। স্বল্প-সময়ে বিচারিকরা যেভাবে রায়ের সামারি লেখেন, দেখা গেলো স্বল্প অভিজ্ঞতার কারণে ইসির কর্মকতরা সেটা পারবেন না; এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়টি অসুবিধা। এরপরও বিষয়টি স্পর্শকাতর তাই সুবিধা ও অসুবিধাগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়নি বলেও জানান সাবেক আমলা এই নির্বাচন কমিশনার। ইসি সূত্র বলছে, ইতিমধ্যে নিজস্ব কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার ক্ষেত্রে ট্রের্নিংসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে। বিচারিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ হিসেবে হাইয়ার করা হবে বিচার বিভাগের দক্ষ কর্মকর্তা এবং বিসিএস একাডেমির কর্মকর্তাদের। তারা এসে এখানের কর্মকর্তাদে প্রশিক্ষণ দিবেন। রায়ের সামারী লেখাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রশিক্ষকরা জ্ঞানগর্ভ অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, নির্বাচনে প্রার্থীদের আচরণ বিধি লঙ্ঘনসহ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ইসির কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে আগামীতে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। এ লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এখানের কোনো কর্মকর্তা তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন না। বিসিএস একাডেমী ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা এসে তাদের বিচারিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিবেন। প্রস্তুতি কি এ বিষয়ে ইসির আইনের যুগ্ম-সচিব মো. মাহবুবার রহমান সরকার বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসির কর্মকর্তা ১৫০ আসনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হতে ইচ্ছুক। তবে সিইসিসহ কমিশনার ছোট কিছু সংসদীয় আসনে তাদের দায়িত্ব দিয়ে পরখ করতে আগ্রহী। সংসদের সাধারণ নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়। আগামী নির্বাচনে কিছুটা পরিবর্তন এনে ইসির কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হতে পরে। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ইসির দক্ষ কিছু কর্মকর্তা রয়েছে। আমরা চিন্তা ভাবনা করছি ছোট কিছু সংসদীয় আসনে তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা যায় কি না। তবে এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে সব কিছু। কমিশন সভায় এ বিষয়ে সূরাহ হবে।