জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে \ সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে উঠা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী)’দের নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর হচ্ছে সরকার। বিবাহ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ফেরাতে নিবন্ধন ও তালাক নিবন্ধনসহ আনুষঙ্গিক খরচ নির্ধারিত ফি এর অতিরিক্ত নেয়া যাবে না। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে বাতিল করা হবে কাজীর নিবন্ধন। এ ছাড়া নিবন্ধন বহি সংরক্ষণ না করা, অধিক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে বিবাহ নিবন্ধন করা বা অতিরিক্ত নিবন্ধন ফি আদায় করার অভিযোগ উঠলেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে আইন মন্ত্রণালয়। বিধি-বর্হিভূত অনিয়মের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯জন নিকাহ-রেজিস্ট্রারকে কারণ দর্শানোর নোর্টিশ প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি অনিয়ম প্রমাণের অভিযোগে ২জন নিকাহ রেজিস্ট্রারের নিবন্ধন বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। মূলত বিধি-বর্হিভূত বিবাহ পড়ানোয় অনিয়মের কারণে আরও অনেক কাজী রয়েছে মন্ত্রণালয়ের নজরদারীতে। তথ্য গোপন করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ পড়ালে তা প্রমাণিত হলেও নিবন্ধন বাতিল হবে সংশ্লিষ্ট কাজীর। সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে দি মুসলিম ম্যারিয়েজ অ্যান্ড ডির্ভোসেস (রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট ১৯৭৪ বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা হয়েছে। আগামী বৈঠকে এ ইস্যুতে আলোচনা হবে। বৈঠকে উপস্থাপিত নথি পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, সারাদেশে বিবাহ পড়ানোর কাজে নিয়জিত কাজীদের অঘোষিত একটা দৌরত্ব থাকে। আমরা বিভিন্নমহল থেকে অভিযোগ-ও পেয়ে থাকি। কিভাবে অনিয়ম বর্হিভূত অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া কাজীদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সেজন্য সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছিল। কমিটির অনুশাসন মেনে তথ্য দিলেও গত ২২ ফেব্র“য়ারি সভায় আলোচনা করা যায়নি। আশা করছি, শিঘ্রই আরেকটি সভা ডেকে শুধু এ ইস্যুতে আলোচনা করা হবে। তিনি বলেন, বাল্য-বিবাহসহ সব সব ধরণের অনিয়ম বন্ধে শুধু আমি না কমিটির সব সদস্য একমত। কারণ এ বিষয়ে সরকার কাজীদের স্বচ্ছতায় ফেরাতে কঠোর। নধি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একজন নিকাহ রেজিস্ট্রোর ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার টাকা দেনমোহর বা এর অংশ বিশেষের জন্য সাড়ে ১২টাকা হারে নিবন্ধন ফি নিতে পারবেন। তবে দেনমোহরের পরিমাণ ৪লাখ টাকার অধিক হলে পরবর্তী প্রতি ১লাখ টাকা দেনমোহর বা এর অংশ বিশেষের জন্য ১০০ টাকা বিবাহ নিবন্ধন ফি আদায় করতে পারবেন। তথ্য বলছে, দেনমোহরে পরিমাণ যাই হোক না কেন সর্বনি¤œ ফি হবে ২০০ টাকা। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের (তালাক) জন্য নিবন্ধন ফি নিতে পারবেন কাজীরা ৫০০টাকা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে নির্ধারিত ফি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না কাজীরা। বিবাহ বাবদ সরকারি নির্ধারিত ফি এর বাইরে অতিরিক্ত অর্থ নেন তারা। মধ্য ও উচ্চবৃত্তরা বেকায়দায় না পড়লেও নি¤œ-মধ্যবৃত্তরা পড়েন বিপাকে। অনেক সময় কাজীর অতিরিক্ত ফি এর প্রতিবাদ করায় বিবাহ পড়াতেও অস্বীকৃতি জানান। কোনো কোনো কাজী আগেই চুক্তি করে পরে বিবাহ পড়াতে আসেন। টেকনাফে নিকাহ ও তালাকনামা রেজিষ্ট্রি অফিসে অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গা ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের নিকাহ রেজিস্ট্রির অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া প্রথম স্ত্রী থাকার পরও দ্বিতীয় বিয়ের রেজিস্ট্রিাও হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। টকনাফের মধ্যহ্নীলায় হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নিকাহ ও তালাকনামা রেজিস্ট্রি অফিসের কাজী আকতার কামাল নুরীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, হোয়াইক্যং লম্বাবিলে বসবাসরত মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা হোছন আলীর মেয়ে মনিরা বেগম এবং একই গ্রামের বসবাসরত আবু তৈয়বের পুত্র মো. আয়ুবের সহিত রেজিস্ট্রিমূলে বিবাহ সম্পাদন হয়। বর্তমানে মনিরা ও আয়ুব দুইজনে স্বামী-স্ত্রী। তারা দুইজনে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী রেজিস্ট্রি কাবিননামা করে বিয়ে করেন। এরা বার্মা থেকে এসে হোয়াইক্যং লম্বাবিল, তেচ্ছিব্রিজ গ্রামে থাকেন। বিয়ের কাবিননামাতে মো. আয়ুব ঠিকানা দেখিয়েছে পেকুয়া উপজেলার মগনামার গ্রামে আর মনিরা বেগমের ঠিকানা হোয়াইক্যংয়ের লম্বাবিলের। সমাজকর্মীরা বলছেন, এই সুযোগ নিচ্ছেন কাজীরা মানুষের অসচেতনতার কারণে। ইতিমধ্যে অনেক কাজীর নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। অনেকেই নজরদারিতে আছে। জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার (র্স্কাস) ট্রাস্টি চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা বলেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে মানুষের জীবনে বিবাহ একবারেই হয়। তাই অনেকেই নির্ধারিত ফি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় কাজী যা চাই, তা দিয়ে দেন। কিন্তু কাজীদের কোন দেনমোহরের জন্য কত ফি তা জানলেও মানুষের সচেতনা কম থাকায় -এ সুযোগটা তারা নেন। কারণ প্রতিটি মানুষের পেশার মধ্যে একটা অসততা ঢুকে গেছে। এখানে স্বচ্ছতা ফেরাতে গেলে প্রত্যেকটি কাজী অফিসের বাইরে সরকার নির্ধারিত ফি টাঙাতে হবে, তাহলে অনিয়ম বন্ধ হবে। এদিকে, সরকারি নির্ধারিত ফি থেকে বড় মোটা অংকের অর্থ জমা হচেছ রাষ্ট্রীয় কষাগারে। গত অর্থবছরে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২২টি অনিয়মের তদন্তের জন্য পত্র পাঠানো হয়েছে। বর ও কনের বয়সের বিষয়টি সুনিশ্চিত হওয়া প্রত্যক নিকাহ রেজিস্ট্রারের উপর বাধ্যতামূলক হওয়ায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত তদারকি করছে। সূত্র বলছে, সমগ্র বাংলাদেশের নিকাহ রেজিস্ট্রোরদের তথ্য সংবলিত একটি অনলাইন ডাটাবেজ তৈরির কাজ প্রক্রিয়াধিন রয়েছে। এই ডাটাবেজটি উন্মুক্ত করার পর যেকোন ব্যক্তি অনলাইনে বাংলাদেশের যেকোন স্থানের নিকাহ রেজিস্ট্রারের নাম, লাইসেন্স, নম্বর ও যোগাযোগের ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য দেখতে পাবেন। এতে ভূয়া নিকাহ নিবন্ধন সনাক্ত করা সহজ হবে এবং বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে উলেখযোগ্য ভূমিকরা রাখবে। এ ছাড়া বিবাহ নিবন্ধনের মাধ্যমে আয় থেকে সরকারের কষাগার সমৃদ্ধ হচ্ছে লাইসেন্স প্রাপ্তি ফি ও বাৎসরিক ফি ও বিবাহ নিবন্ধন ফি থেকে ২০১৯-২১ সাল পর্যন্ত আয় হয়েছে ৭ কোটি ২৫ হাজার ৫৮ টাকা।