স্টাফ রিপোর্টার \ বৈশ্বিক বিরূপ জলবায়ুর প্রভাবে চাষিদের আবাদের তালিকা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গম চাষ। শ্রমিক সংকট, লাভ কম, ইঁদুরের উপদ্রব, মাড়াইয়ের সমস্যা, ভালো বীজের অভাব ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে গম চাষে চাষিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে তারা গমের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে ঝুঁকছেন। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সাতক্ষীরার তত্তাবধানে গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রল্পের বারি গম-৩০ বারি মৌসুম-২০২১-২০২২ থাকলেও নিজ উদ্যোগে অন্য সব ফসলের মতো গম চাষ খুব কম হচ্ছে। গত ৬ বছরে শুধু সাতক্ষীরা জেলায় গমের আবাদ হ্রাস পেয়েছে ৪৮ ভাগ জমিতে। ২০১৬ সালে জেলায় গমের আবাদ হয় ১৫৬৬ হেক্টর জমিতে আর ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮১০ হেক্টরে। একই অবস্থা উপকূলের জেলা সমূহে। বিশ্বের অন্যতম দানাদার খাদ্যশস্য গমের অবস্থান বাংলাদেশে দ্বিতীয়। স্বাধীনতার পর ধানের মতো গম উৎপাদন এলাকা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও নানা কারণে আশানুরূপ বাড়েনি। ১৯৭১ সালে দেশে চাল উৎপাদন ছিল প্রায় এক কোটি টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে। কিন্তু গম উৎপাদন ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে হয়েছিল প্রায় ১৯ লাখ ৮ হাজার টন, আর বর্তমানে তা ১৪ লাখ টনের কাছাকাছি এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। এক সময় ভারত থেকে আমদানীকৃত গমের আলগাঝুল রোগ এ দেশে বিস্তার করে। ২০১৬ সালের ফেব্র“য়ারির মাঝামাঝিতে সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল, ভোলা প্রভৃতি জেলায় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর গমের জমিতে মারাত্মক ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে; যা মোট আবাদি জমির প্রায় ৩ শতাংশ। এ রোগে ফলন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফসল প্রায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। একের পর এক নতুন রোগবালাই নিরাময় এবং বিপর্যয় উত্তরণের প্রযুক্তি না জানার শঙ্কায় কৃষকরা গমের চাষ হ্রাস করে। মাগুরা গ্রামের মমতাজ উদ্দিন (৫০) বলেন, ‘বাবা, গম আবাদ বাদ না দিয়া করমো কী? এ্যালা তো গমের ফলন ভালো হয় না। কাটা মাড়াইয়েরও মানুষ পাওয়া যায় না। গম তুলি জমিত ধান গাড়লেও ভালো হয় না। ওই জন্যে মুই গমের আবাদ বাদ দিয়েছি। দেবহাটা উপজেলার আব্দুল হাফিজ বলেন, অন্য ফসলের উন্নত মানের জাত ও বীজের গুনাগুণ, গুনগত মান সম্পর্কে আমরা সহজে জানতে পারি কিন্তু গমের জাত ও বীজের গুনাগুণ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা। তবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আমাদের মাঝে প্রশিক্ষণ প্রদান করে গমের চাষ পদ্ধতি ও উন্নত জাতের বীজ সম্পর্কে অবগত করলে ভালো হবে। তবে গমের আবাদ হ্রাস পেলেও উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে তিন লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর জমিতে গম উৎপাদন হয় আট লাখ ৪৯ হাজার টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চার লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ৪৭ হাজার টন গম উৎপাদিত হয়। ২০১৭-১৮ মৌসুমে হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৩.২৮ টনে উন্নীত হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী দেশে গমের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টন। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের গমের উৎপাদন বেড়েছে ২০ শতাংশ। সাতক্ষীরা জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর উপজেলায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে গম চাষ হলেও সেটা এবার নেমে এসেছে ৮১০ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এবার গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এর স্থলে বর্জন হয়েছে। জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলায় দিন দিন গমের চাষ ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, গম চাষের উপযোগী জমিতে উচ্চ মূল্যের সবজি চাষ হওয়ায় গম চাষ কমে যাচ্ছে। তাছাড়া এ বছরে গম চাষের উপর কৃষকের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি। সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা, কৃষকদের মাঝে প্রদান করা হয়েছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, ভোগ্যবস্তু বহুমুখী করণ ও গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসনে গম চমকপ্রদ অবদান রাখতে পারে। চাষের এলাকা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে তলাবিহীন ঝুড়ির বিদ্রƒপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধান আর আলুর মতো সোনালি গম উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা দেশের মাটি ও মানুষের।