এফএনএস এক্সক্লুসিভ: দেশের শিক্ষা বোর্ডে কর্মরতরা সরকার নির্ধারিত বেতনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভাতা ও সম্মানি নিচ্ছে। মূলত শিক্ষার্থীদের দেয়া পরীক্ষার উচ্চ ফি থেকে বোর্ডগুলো বাড়তি আয় করছে। আর তা থেকেই বোর্ডের কর্মকর্তা—কর্মচারীরা বছরৈ আটটি বোনাস নিচ্ছে। অথচ সরকারি কর্মকর্তা—কর্মচারীরা দুই ঈদে সরকার নির্ধারিত মূল বেতনের সমান দুটি উৎসব ভাতা এবং মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা পেয়ে থাকে। কিন্তু দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা—কর্মচারীরা নিজেরা নিয়ম করে মূল বেতনের সমপরিমাণ আরো পাঁচটি উৎসব ভাতা নিয়ে থাকে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বোর্ডের কর্মকর্তা—কর্মচারীরা ১২ মাসে আটটি বোনাস নেয়। তাছাড়া অফিসের নির্ধারিত সময়ে বোর্ডগুলোতে প্রায় প্রতিদিন কর্মকর্তাদের একাধিক বৈঠক করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা সম্মানি নেয়। শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিভিন্ন পরীক্ষার ফি থেকে দেশের বোর্ডগুলো বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করে। আর এতো টাকা তাদের ব্যয় করারও সুযোগ নেই। তাই তারা নিজেরাই নিয়ম করে দীর্ঘদিন ধরে বছরে আটটি বোনাস ও নানা ধরনের সম্মানি নিচ্ছে। যে বোর্ডে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যতো বেশি, তাদের আয়ও ততো বেশি। আর নিজস্ব আয় থাকায় তারা ইচ্ছামতো খরচও করতে পারে। আর ওই অর্থ ব্যয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী প্রতিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান। কারণ শিক্ষা বোর্ডগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তাদের নিজস্ব কর্মকর্তা—কর্মচারীর পাশাপাশি উচ্চ পদগুলোতে সাধারণত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রেষণে পদায়ন পেয়ে থাকেন। যদিও বোর্ডের আইনে কর্মকর্তা—কর্মচারীদের জন্য আলাদা করে বিভিন্ন ভাতা বা সনদ ও নম্বরপত্রে স্বাক্ষরের জন্য টাকা নেয়ার বিধান নেই। কিন্তু বোর্ড সভা ও অর্থ কমিটিতে নিজেরাই ওসব ভাতা ও স্বাক্ষরের জন্য টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে নিয়েছে। পরে তা মন্ত্রণালয় থেকেও অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। সূত্র জানায়, স্কুল—কলেজের পাবলিক পরীক্ষায় দিতে হয় বড় অঙ্কের ফি। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সারা বছরই লেগে থাকে পরীক্ষা। সেজন্য শিক্ষার্থীদের বছরে অন্তত দুই থেকে তিনবার পরীক্ষার ফি দিতে হয়। অনেক স্কুলে টিউশন ফি কম হলেও পরীক্ষায় উচ্চ ফি থাকে। ওই ফি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্যও মওকুফ করা হয় না। আর পরীক্ষার ফির টাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল ফান্ডের সঙ্গেও যোগ করা হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খরচ বাদে বাকি টাকা ভাগ—বাটোয়ারা করা হয়। অথচ ফি দিতে না পারা অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ফরম পূরণ করে ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ বাবদ বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থীদের (নিয়মিত) জন্য নেয়া হয় দুই হাজার ২৪০ টাকা। ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থীদের (নিয়মিত) জন্য নেয়া হয় দুই হাজার ১২০ টাকা। ফলে শুধু এসএসসি পরীক্ষার ফি থেকে ১১ শিক্ষা বোর্ডের আয় হয়েছে ৪২৯ কোটি টাকা। সেখান থেকে কেন্দ্র ফি বাবদ শিক্ষার্থীপ্রতি ৪৫০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তাছাড়া ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ফরম পূরণ করে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন। ফরম পূরণ বাবদ বিজ্ঞান শাখার পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোট দুই হাজার ৬৮০ টাকা এবং মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুই হাজার ১২০ টাকা করে ফি নেয়া হয়েছে। সেই হিসাবে পরীক্ষার ফি বাবদ বোর্ডের আয় হয়েছে প্রায় ৩০৭ কোটি টাকা। ওই টাকা থেকেও এসএসসির মতো ব্যয় করে বড় অঙ্কের টাকা জমা রয়েছে। দুই পরীক্ষার ফি হিসাব করলে দাঁড়ায় ৭৩৬ কোটি টাকা। দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি মিলে বোর্ডের সংখ্যা ১১। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঢাকা বোর্ড। আর সারা দেশের মাদরাসাগুলোর জন্য একটি বোর্ড হওয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ওই বোর্ড। সূত্র আরো জানায়, সরকার নির্ধারিত দুই ঈদে দুই উৎসব বোনাস ও বৈশাখী ভাতার পাশাপাশি বোর্ডের কর্মকর্তা—কর্মচারীরা মূল বেতনের সমান বর্তমানে আরো পাঁচটি ভাতা পেয়ে থাকে। এসএসসির রেজিস্ট্রেশনের সময় পান মূল বেতনের অর্ধেক বোনাস, পরীক্ষা শুরুর সময় অর্ধেক, পরীক্ষা শেষে একটি পূর্ণ বোনাস এবং ফল প্রকাশিত হলে আবার অর্ধেক বোনাস পেয়ে থাকেন। একইভাবে এইচএসসি পরীক্ষার সময়ও তারা বোনাস পেয়ে থাকে। এভাবে অতিরিক্ত পাঁচটি বোনাস নেন বোর্ডের কর্মকর্তা—কর্মচারীরা। এর বাইরে বোর্ডের কর্মকর্তারা প্রতিটি সনদে স্বাক্ষরের জন্য এক টাকা করে পেয়ে থাকে। শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধনী ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। তাদের খরচ ও ভাতা—সম্মানিও বেশি। ইচ্ছামতো খরচের পরও ঢাকা বোর্ডের কয়েকশ’ কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। এরপরও প্রায় প্রতি বছরই বাড়ানো হচ্ছে পরীক্ষার ফি। বোর্ড সংশ্লিষ্টদের দাবি, কর্মকর্তা—কর্মচারীদের পরীক্ষাকেন্দ্রিক বেশি কাজ করতে হয় বলেই ওই ধরনের ভাতার উদ্যোগ। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই কোনো উদ্যোগ নিতে হবে। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি অ্যাফিলিয়েটেড বিশ্ববিদ্যালয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩১ লাখ। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ পরীক্ষার ফি নেয়া। তাদের অধীনে নানা ধরনের পরীক্ষা হয়। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো পরীক্ষা থাকে। সব খরচ নির্বাহ করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডেও শত শত কোটি টাকা রয়েছে। এরপরও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার ফি বাড়িয়ে যাচ্ছে। আর শিক্ষকদের নিবন্ধনের জন্য বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানটি প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নামে শিক্ষকদের নিবন্ধন দিয়ে থাকে। একেকটি নিবন্ধনে কয়েক লাখ প্রার্থী অংশ নেন। এরপর তারা চাকরির সুপারিশের আবেদনের জন্যও আলাদা ফি নেয়। তাতে ২০০৫ সাল থেকে চালু হওয়া প্রতিষ্ঠানটির ফান্ডেও বড় অঙ্কের টাকা জমা হয়েছে। কিন্তু তাদেরও পরীক্ষার ফি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার জানান, শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তা—কর্মচারীরা আটটি বোনাস নেয়ার পরও ফান্ডে শত শত কোটি টাকা রয়েছে। এখন পরীক্ষার ফি ফ্রি করে দেয়ার সময় হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার জানান, বোর্ড খাতভিত্তিক হিসাব করে পরীক্ষার ফি নিয়ে থাকে। প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ করা পর্যন্ত নানা খাতে ব্যয় রয়েছে। যাতে ওই ফির বেশির ভাগ খরচ হয়ে যায়। তবে অনেক সময় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বোর্ডের ফির সঙ্গে আরো কিছু টাকা যোগ করে শিক্ষার্থীদের ফি নির্ধারণ করে, যা মোটেই ঠিক নয়। তবে বোর্ডের নির্ধারিত পরীক্ষা ফি কিছুটা কমানো যায় কি না সে বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডে ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।