এফএনএস : আদালতে বেশিরভাগ মামলা আসামির বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষে পুলিশ অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিলেও আদালতের রায়ে ৭২ শতাংশ মামলাতেই আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। আর পুলিশের জমা দেয়া চার্জশিটে বিচারে শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে মাত্র ২৮ শতাংশ মামলায়। বেশিসংখ্যক মামলায় আসামির বিচার নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলা দায়েরের সময়েই ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। ভুয়া তথ্য দিয়ে মামলা দায়ের, নির্দোষ ব্যক্তিদের আসামি করা, সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে তদন্ত না করা, ভুয়া সাক্ষী রাখা এবং বিচার চলাকালে সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারায় বেশিরভাগ মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতায় গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া, পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগ ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ঠিকঠাকভাবে মামলা পরিচালনায় ব্যত্যয় থাকাতেও অধিক মামলাতে আসামি খালাস পাচ্ছেন। ফলে ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। পুলিশ বিভাগ এবং আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারাদেশের আদালতগুলোতে বিগত আগস্ট মাসে ৬ হাজার ২১১টি মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৫৩৬টি মামলায় সাজা হয় আর ৪ হাজার ৩০১টি মামলায় আসামি খালাস হয়। ওই হিসাবে ওই মাসে ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ মামলায় সাজা নিশ্চিত হয় এবং ৬৯ দশমিক ২৫ ভাগ মামলায় আসামি খালাস পেয়েছে। আর ওই মাসে ৩৭৪টি (৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ) মামলা অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়। সেপ্টেম্বর মাসে ৮ হাজার ২২৪টি মামলার রায় হলেও এর মধ্যে ১ হাজার ৮৩৯টি মামলায় সাজা নিশ্চিত হয় এবং ৫ হাজার ৮৬৮টি মামলায় আসামি খালাস পায়। ওই হিসাবে ওই মাসে ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ মামলায় সাজা ও ৭১ দশমিক ৩৫ ভাগ মামলায় খালাস হয়। আর ওই মাসে ৫১৭টি মামলা (৬ দশমিক ২৮ শতাংশ) অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়। এভাবে প্রতি মাসের বিচার নিষ্পত্তিতে বেশি মামলায় সাজার চেয়ে খালাস হচ্ছে। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের আদালতগুলোতে মোট ২২ হাজার ২২২টি মামলার বিচার নিষ্পত্তি (সাজা ও খালাস) হয়। আর বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ৭১ দশমিক ৯৭ শতাংশ মামলায় আসামি খালাস পেয়েছে। সূত্র জানায়, মামলায় অধিকসংখ্যক আসামি খালাসের বিষয়ে স¤প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের এক বৈঠকে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে মামলায় সাজার হার বাড়াতে তদন্ত কর্মকর্তা অনুপাতে মামলার ভারসাম্য করার বিষয়ে জোর দেয়া হয়। জেলার পুলিশ সুপার, রেঞ্জ ডিআইজি এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারদের একটি মনিটরিং সেল গঠন করে সাজার হার বাড়াতে প্রতি মাসে এ বিষয়ে আলোচনা করার কথা বলা হয়। বৈঠকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সাজার হার ও খালাসের হার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুলাই মাসে সারা দেশে ৯ হাজার ৭৮টি মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়। অর্থাৎ আদালতে ওই মামলাগুলোর রায় হয়েছে। ওই মাসে বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ২ হাজার ৮৫২টি মামলায় সাজা হয়, অর্থাৎ মোট বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সাজার হার মাত্র ৩১ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে ৬৪ দশমিক ১৮ শতাংশ বা ৫ হাজার ৮২৬ মামলার আসামি খালাস হয়। ৪০০টি মামলা (৪ দশমিক ৪১ শতাংশ) অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়। সূত্র আরো জানায়, মামলা দায়েরের শুরুতেই ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। আর ত্রুটিযুক্ত মামলায় ভালো চার্জশিটও আশা করা যায় না। তাছাড়া ডাকাতি বা বাসায় চুরির মামলা হলে বাদীই সাক্ষীদের তালিকা দিয়ে থাকে। কিন্তু ওই মামলার বিচার চলাকালে সাক্ষীরা ঠিকঠাক সাক্ষ্য দিতে পারছে না। মারামারি বা সংঘর্ষের মামলাগুলোতে চিকিৎসা দেয়া সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ওই মামলায় বড় সাক্ষী। কিন্তু বিচার চলাকালে তাকে সাক্ষ্য দিতে হাজির করা যায় না। ফলে আসামি খালাস হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া, অনেক ক্ষেত্রে ভুল তদন্ত ও ভুয়া সাক্ষীর কারণেও আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। জেলা পর্যায়ে অনেক সময়ে খালাস হওয়া মামলাগুলো নিয়ে জজ, পুলিশ কর্মকর্তা ও পাবলিক প্রসিকিউটর পর্যায়ে মিটিং হয়। আসামি কেন খালাস হলো ওসব মিটিংয়ে তা নিয়ে আলোচনা হয় এবং অনেক ত্রুটি বেরিয়ে আসে। কিন্তু ওই ত্রুটিগুলো বন্ধ করতে পরে আর কোনো পক্ষই কাজ করে না। ফলে মামলায় সাজা নিশ্চিতের চেয়ে খালাস বেশি হচ্ছে। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) থানাগুলোতে দায়ের মামলাগুলোয় গড়ে সাজার হার সবচেয়ে কম। পুলিশের ইউনিটগুলোর মধ্যে মাদকের মামলাতেও ডিএমপিতে সাজার হার সর্বনিম্ন। জুলাই মাসের পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী বরিশাল মহানগরের থানাগুলোয় দায়ের মামলার বিচার নিষ্পত্তিতে সর্বোচ্চ প্রায় ৫১ ভাগ সাজা হয়েছে। রাজশাহী মহানগর পুলিশে (আরএমপি) ৪০ দশমিক ১৬ ভাগ এবং চট্টগ্রাম রেঞ্জের থানাগুলোতে প্রায় ৪০ ভাগ মামলায় সাজা হয়। ওই মাসে ডিএমপিতে ২২ দশমিক শূন্য ৮ ভাগ মামলায় সাজা হলেও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে (সিএমপি) ১৯ দশমিক ৪১ ভাগ এবং রংপুর রেঞ্জে ২৩ দশমিক ৪৮ ভাগ মামলায় সাজা হয়। তাছাড়া আগস্ট মাসে গাজীপুর মহানগর এলাকার থানাগুলোয় প্রায় ৬৭ ভাগ মামলায় সাজা হয়। ওই মাসে ডিএমপিতে ১৩ দশমিক ৩৬ ভাগ মামলায় সাজা হয়। এছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে বরিশাল মহানগরে সর্বোচ্চ প্রায় ৪১ ভাগ মামলায় সাজা হয়। ডিএমপিতে মাত্র ১২ দশমিক ৮২ ভাগ মামলায় সাজা হয়। তাছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায়ও সাজার হার কমছে। জুলাই মাসে বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মাদকের ৫০ দশমিক ১৯ ভাগ মামলায় সাজা হয়। পরের মাসে তা ৪১ দশমিক ৫৯ ভাগ এবং সেপ্টেম্বরে মাদকের মামলায় সাজার হার ৩৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয়। এর মধ্যে জুলাইয়ে পুলিশের ইউনিটগুলোর মধ্যে রংপুর মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ প্রায় ৭৯ ভাগ মাদকের মামলায় সাজা হয়। পাশাপাশি ডিএমপিতে সর্বনিম্ন ২৮ দশমিক ৫৫ ভাগ মামলায় সাজা হয়। পরের মাসে রংপুর মহানগর পুলিশের থানাগুলোয় সর্বোচ্চ ৬৮ দশমিক ৪২ ভাগ মাদকের মামলায় সাজা হয় এবং ডিএমপিতে সর্বনিম্ন ১৭ দশমিক ১৮ ভাগ মামলায় সাজা হয়। সেপ্টেম্বরেও রংপুর মহানগর পুলিশের থানাগুলোয় সর্বোচ্চ প্রায় ৭৯ ভাগ মাদকের মামলায় সাজা হয় এবং এ মাসেও ডিএমপিতে সর্বনিম্ন ১৫ দশমিক ৭৫ ভাগ মামলায় সাজা হয়। অন্যদিকে মামলায় সাজার হার যাতে বাড়ে, সেজন্য প্রতিনিয়তই তদন্ত কর্মকর্তাদের নিখুঁতভাবে তদন্ত ও চার্জশিট দিতে বলা হয়। বিষয়গুলো নিয়ে জেলা মনিটরিং সেলেও আলোচনা হয়। কিন্তু মামলায় সাজার হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে প্রসিকিউশন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোরও আন্তরিকতা দরকার। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর জানান, মামলায় খালাস বা সাজার হারের পরিসংখ্যান নিয়ে মন্তব্য নেই। তবে প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত কার্যক্রম যাতে সঠিক হয়, পুলিশ সদর দপ্তর সেই বিষয়ে বরাবরই ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় সেজন্য নজরদারি ও তদারকি থাকে। পাশাপাশি মামলার তদন্তের জন্য মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া চাঞ্চল্যকর বা তুলনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর তদন্তে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিবিড়ভাবে তদারকি করেন। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য প্রতিনিয়তই ইনসার্ভিস ট্রেনিংয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী জানান, নানা কারণেই মামলার রায়ে আসামি খালাস হচ্ছে। একটা মামলার রায়ে সাক্ষী গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে তা হচ্ছে না। পুলিশের মাধ্যমে সমন জারি করেও সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না। আর মাদকের মামলায় সিজার লিস্টে থাকা সাক্ষী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেখা যায় পথচারী, বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী বা ভাসমান লোক সিজার লিস্টে সাক্ষী করা হয়। অনেক সময় পর মামলার বিচারকাজ শুরু হলে ওই ভাসমান সাক্ষী আর পাওয়া যায় না। তাছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা বা যৌতুকের মামলাগুলোর বেশিরভাগই আদালতের বাইরে মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে। স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করলেও বাইরে মীমাংসার পর তা চালাচ্ছে না। তাছঅঢ়অ সাক্ষী বা বাদী আদালতে আসে না। এমন অবস্থায় ওসব মামলায় তো আসামি খালাস হবেই।