এফএনএস : দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে পড়ার আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে দেশের আমদানি ব্যয় বাড়লেও কাক্সিক্ষত হারে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে না। ফলে ডলারের বিনিময় হারের সাথে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি ৬৪ শতাংশ বেড়েছে। আর যে হারে আমদানি ব্যয় বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে আর্থিক বছর শেষে বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। তাতে ডলারের দাম টাকার বিপরীতে আরো বেড়ে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতিসহ সামগ্রিক অবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়ার আশঙ্কাও বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে ওই ঘাটতির (ঋণাত্মক) পরিমাণ এক হাজার ৪০৭ কোটি ৭২ লাখ ডলার দাঁড়িয়েছে। অথচ আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতির অঙ্ক ছিল ৫৫৫ কোটি ডলার। সামগ্রিক লেনেদেনে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে এ সূচকে ৬৯৯ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়েও চাপ বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোতে ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আর সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে। আর একই সময়ে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আর্থিক বছর শেষে চাপের মুখে পড়ে যাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ইতোমধ্যে রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের রেকর্ড ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন (২২৪ কোটি) ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রিজার্ভ ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তার আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১.২৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানের আমদানির খরচ হিসাবে রিজার্ভ দিয়ে ৫ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। অথচ অর্থবছরের প্রথমদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ১০ থেকে ১১ মাসের আমদানি খরচ মেটানোর রিজার্ভ ছিল। সূত্র আরো জানায়, অস্বাভাবিক হারে আমদানি দায় বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতিও বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ২ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৫২১ কোটি ডলার। এই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ৪০ লাখ (৬১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ওই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। আর চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রফতানিকারকরা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। আমদানি ব্যয় থেকে রফতানি আয় বাদ দিলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার। তাছাড়া অর্থবছরের ৯ মাসে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৭০৮ কোটি ডলার আর সেবা খাতে দেশের ব্যয় হয়েছে ৯৯৮ কোটি ডলার। ওই হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮০ কোটি ডলার। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৯৯ কোটি ডলার। এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, টাকার মান কমে গেলে বহুমুখী চাপে পড়বে দেশ। কারণ এদেশের অর্থনীতি আমদানি নির্ভরতা বেশি। টাকার মান কমে গেলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। ফলে বেড়ে যাবে স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যয়ও। তাতে দেশীয় বাজারে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। একদিকে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, অপরদিকে মানুষের আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে। সবমিলেই চাপে পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতি। এমন পরিস্থিতিতে অনুৎপাদনশীল পণ্যের আমদানি কমানোর পাশাপাশি মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানির আড়ালে মুদ্রাপাচার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে জরুরি। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশী শ্রমের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা প্রয়োজন।