এফএনএস : বৈদেশিক লেনদেনে মার্কিন ডলার ছাড়াও অন্য দেশের মুদ্রা ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ডলারের দাম দিন দিন আকাশচুম্বী হচ্ছে আর কমছে টাকার মান। ডলারের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে। ফলে বাড়তি দামে পণ্য আমদানি করায় বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই সরকার ডলারের বিকল্প হিসাবে বৈদেশিক লেনদেনে অন্য মুদ্রা ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে বৈদেশিক লেনদেনে বিকল্প মুদ্রা হিসাবে ইউরোর ব্যবহার শুরু হয়েছে। ওই তালিকায় ভারতীয় মুদ্রা রুপি, চীনের মুদ্রা আরএমবি এবং রাশিয়ার মুদ্রা রুবলও রয়েছে। শিল্পখাত এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার, ইউরো, রুপি এবং আরএমবির ব্যবহার অনুমোদন করেছে। আর রাশিয়ার মুদ্রা রুবল অনুমোদনের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় আমদানিতে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করলে সুবিধা পাওয়া যাবে। ভারত ও চীন থেকেই বাংলাদেশ মোট আমদানির ৪০ শতাংশ করে থাকে। ডলারের বিপরীতে ওই দুই মুদ্রার মানও টাকার চেয়ে বেশি কমেছে। ফলে ওই দুই দেশ থেকে নিজস্ব মুদ্রায় আমদানি করলে বেশি সাশ্রয় হবে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রুপি ও আরএমবির জোগান বাড়াতে হবে। রিজার্ভের একটি অংশ ওসব মুদ্রায় রাখতে হবে। সূত্র জানায়, দেশে গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম ১২ শতাংশ বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশী মুদ্রা নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুদ্রার বিপরীতেও ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে ডলারে এলসি করে পণ্য আমদানি করলে দাম বেশি পড়ছে। কিন্তু ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রায় পণ্য আমদানি করলে ব্যয় কম হবে। তাতে বৈদেশিক লেনদেনে সাশ্রয় হবে। ওই কারণে ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রায় লেনদেনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ভারতের বৈদেশিক লেনদেনের প্রধান মুদ্রা ডলার। কিন্তু দেশটি জাপানের সঙ্গে দুই দেশের নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন সম্পন্ন করছে। তাতে বছর শেষে যে লেনদেন বকেয়া থাকছে, পরের বছর তা সমন্বয় করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়াও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করছে। চীন তাদের মুদ্রায় অনেক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করছে। বাংলাদেশের সঙ্গেও নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করার কাঠামো তৈরি করেছে ঢাকা-বেইজিং। রাশিয়া তাদের নিজস্ব মুদ্রায় চীন, ভারতসহ অনেক দেশের সঙ্গে লেনদেন করছে। তার মাধ্যমে ডলারের উত্তাপ থেকে তাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সূত্র আরো জানায়, একক দেশ হিসাবে চীনের সঙ্গেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য রয়েছে। তার পরের অবস্থানেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। আর অঞ্চল হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয়। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৬ শতাংশ এবং রপ্তানির ৩ শতাংশ চীনের সঙ্গে হয়। চীনে রপ্তানি কম হওয়ায় আরএমবি আয় হবে কম। অন্যদিকে আমদানি বেশি হওয়ায় আরএমবি ব্যয় হবে বেশি। ফলে চীনা মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেবে। ওই ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আরএমবির জোগান দিতে হবে। সেজন্য রিজার্ভে যথেষ্ট পরিমাণে আরএমবি রাখতে হবে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ২৬ শতাংশ এবং আমদানির সাড়ে ৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হয়ে থাকে। ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানি করে ভালো আয় হচ্ছে। কিন্তু আমদানিতে বেশি ব্যয় হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি কম হওয়ায় কিছুটা সাশ্রয় হচ্ছে। আর ভারতের সাথে বাংলাদেশের মাট আমদানির সাড়ে ১৪ শতাংশ এবং রপ্তানির ৩ শতাংশ হয়। ডলারে ওসব লেনদেন সম্পন্ন হয়। ফলে আমদানি বেশি বলে খরচও বেশি হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যে টাকা ও রুপি ব্যবহার করলে বেশ সাশ্রয় হবে। কেননা ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতন টাকার চেয়ে বেশি হয়েছে। কিন্তু ভারতে রপ্তানি কম বলে রুপির জোগান কম। সেক্ষেত্রে টাকা রুপির বিনিময়ে জোর দিতে হবে। তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেদেশের মোট রপ্তানির ৫৬ শতাংশ এবং আমদানির ৮ শতাংশ হয়। ইউরোর দাম কমায় রপ্তানি আয় কম হবে। আমদানি ব্যয়ও কমবে। কিন্তু ইউরোপ থেকে আমদানি কম। ফলে রপ্তানি করে পাওয়া ইউরো ব্যবহারের ক্ষেত্রে কম। এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়ানো ডলারের বিকল্প হিসাবে অন্য মুদ্রা ব্যবহার করলে ডলারের উত্তাপ থেকে অর্থনীতি কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। ইউরোর দাম এখন কম। তার মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলোয় আমদানি-রপ্তানি করা যেতে পারে। পাউন্ডের দামও কমেছে। তার মাধ্যমেও ইউরোপের দেশগুলোয় লেনদেন করা যেতে পারে। বিকল্প অনেক পথ খোলা রাখতে হবে। যখন যেটি সুবিধা তা ব্যবহার করতে হবে। সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই প্রধান ভ‚মিকা নিতে হবে। বিকল্প মুদ্রাগুলোর রিজার্ভ থাকতে হবে। উদ্যোক্তাদের সুবিধার বিষয়টি বোঝাতে হবে। তাহলেই সুফল মিলবে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, বর্তমানে ইউরোর দাম কমায় ইউরোতে পণ্য আমদানি করলে খরচ কম হবে। কিন্তু রপ্তানি করলে আয় কম হবে। ফলে রপ্তানিকারকরা আয় কম করতে চাইবে না। আবার চীনে রপ্তানি করে যে আরএমবি পাওয়া যাবে তা কেবল চীনেই খরচ করতে হবে। অন্য কোথাও খরচ করা যাবে না। তখন আবার তা অন্য মুদ্রায় রূপান্তর করে আমদানি করতে হবে। তাতে খরচ বাড়বে। ওই কারণে বিকল্প মুদ্রার ব্যবহার কম। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাপোর্ট দিলে আমদানিকারকরা এবং কিছু ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকরাও বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে। তাতে বেশ সাশ্রয় হবে।