মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:২৭ পূর্বাহ্ন

ব্যাগেজ রুলসে বৈধভাবেই দেশে ঢুকছে টন টন সোনা

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় রবিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৫

এফএনএস : ব্যাগেজ রুলসে বৈধভাবেই দেশে টন টন সোনা ঢুকছে। গত চার অর্থবছরে (২০২০—২১ থেকে ২০২৩—২৪) বিদেশ থেকে ১০৪ টনেরও বেশি সোনা লাগেজে করে দেশে এসেছে। ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বৈধভাবে শুল্ক—কর পরিশোধ করে আনা ওই স্বর্ণ পরিমাণে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণ রিজার্ভের (১৪ টন) সাত গুণেরও বেশি। কিন্তু ব্যাগেজ রুলসের আওতায় আনা সোনা খুব কমই গৃহস্থালি খাত বা অলংকার শিল্পে ব্যবহার হচ্ছে। বরং ওই সোনার অন্তত ৯০ শতাংশ প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাচার হয়ে গেছে। বেশির ভাগই নানা হাত ঘুরে সীমান্তে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাগেজ রুলসের সহজ নীতিমালা ও শুল্ক—কর পরিশোধের পর সোনার পরবর্তী গন্তব্য চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ না থাকায় ওসব সোনা খুব সহজেই পাচার হয়ে যাচ্ছে। কাস্টমস, স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও আইন—শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সোনা পাচারকারীদের একটি চক্রের সদস্যদের কাজ হলো শুধু ব্যাগেজ রুলস ব্যবহার করে বিদেশ থেকে সোনা আনা। কখনো কখনো প্রবাসীদেরও তারা এ কাজে ব্যবহার করছে। বিমানবন্দরে খালাস হওয়া ওসব স্বর্ণ নানা হাত ঘুরে সীমান্ত এলাকায় চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাচার হচ্ছে। কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী ২০২০—২১ থেকে ২০২৩—২৪ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে বৈধপথে ১০৪ টন সোনা এসেছে। এর মধ্যে ২০২৩—২৪ অর্থবছরে দেশে এসেছে ১৭ হাজার ৮৯৪ কেজি ৩৭৫ গ্রাম (১৭ দশমিক ৮৯ টন) সোনা। এর আগে ২০২২—২৩ অর্থবছরে এসেছিল ৪৩ হাজার ২০ কেজি (৪৩ দশমিক শূন্য ২ টন)। আর ২০২০—২১ ও ২০২১—২২ অর্থবছরে এসেছে যথাক্রমে ১১ হাজার ৩৪৬ কেজি (১১ দশমিক ৩৪ টন) ও ৩১ হাজার ৭৭৮ কেজি (৩১ দশমিক ৭৭ টন)। সব মিলিয়ে ওই সময় মোট স্বর্ণ এসেছে ১০৪ টনেরও বেশি। অথছ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট স্বর্ণ রিজার্ভের পরিমাণ ৪ লাখ ৫১ হাজার ১৬৮ দশমিক ৬১ ট্রয় আউন্স বা ১৪ টনের কিছু বেশি। সূত্র জানায়, ব্যাগেজ রুলস বিধিমালা অনুযায়ী শুল্ক—কর পরিশোধ করে বিদেশ থেকে একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ১১৭ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের স্বর্ণ আনতে পারে। ওই ১০৪ টন সোনার পুরোটা ব্যাগেজ রুলস বিধির আওতায় বৈধভাবে আনা হয়েছে। গত চার বছরে ৮ লাখ ৯০ হাজারটির কাছাকাছি চালানে বিদেশ থেকে বৈধপথে আনা সোনা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাছাড়া ব্যাগেজ রুলস বিধিমালায় ১১৭ গ্রামের অতিরিক্ত স্বর্ণ আনলে তাও নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা পরিশোধ করে ছাড়িয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত সোনা ‘ডিএমকৃত’ হিসেবে কাস্টমসের তালিকাভুক্ত হয়। কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী ২০২৩—২৪ অর্থবছরে ডিএমকৃত স্বর্ণালংকার খালাস করা হয়েছে ৪১৭ কেজি ৪৩৫ গ্রাম। ২০২২—২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৫৫৪ কেজি ৬৪৩ গ্রাম। ২০২১—২২ ও ২০২২—২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫০৭ কেজি ৮৩৮ গ্রাম ও ৬৯৭ কেজি ৬৬৯ গ্রাম। ওসবের বাইরেও চলতি ২০২৪—২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে গত ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বৈধপথে ১ হাজার ২৬০ কেজি ৯৫০ গ্রাম সোনা দেশে এসেছে। এছাড়া ডিএমকৃত স্বর্ণ এসেছে ৫৫ কেজি ৬৯৪ গ্রাম। সূত্র আরো জানায়, দেশের সোনা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ব্যাগেজ রুলস সুবিধায় ২৬ ধরনের পণ্য আনার ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা কেবল বাহকের ভূমিকা পালন করে। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই তারা লাগেজ ভর্তি পণ্য চোরাকারবারিদের হাতে তুলে দেয়। এতেই প্রতি বছর দেশ হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) সোনা ও হীরা চোরাচালানে বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য—উপাত্ত তুলে ধরে বলেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩০টি জেলার সীমান্ত অবস্থিত। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলা সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে। সোনার বড় একটি অংশ ওসব জেলার সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার হয়ে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ২২০ কোটি টাকার সোনা ও সোনার অলংকার এবং ৩০ কোটি টাকার হীরা ও হীরার অলংকার বাংলাদেশে আসছে। ওই হিসাবে ৩৬৫ দিন বা এক বছরে ৮০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সোনা ও ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার হীরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসছে। এর পুরো টাকাটাই হুন্ডির মাধ্যমে সোনা ও হীরা চোরাকারবারিরা বিদেশে পাচার করে থাকে। ফলে সরকার রেমিট্যান্স হারাচ্ছে এবং সোনা ও হীরা চোরাকারবারিরা তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে যাচ্ছে। বৈধ পথে আনা স্বর্ণগুলো প্রধানত ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় চট্টগ্রামে শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ বৈধ—অবৈধভাবে দেশে আসে। এদিকে আইন—শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্টরা জানান, খুলনা বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গায় চলতি বছরের এ পর্যন্ত ভারতে পাচার হওয়ার সময় ৪১ কেজি ৫৭২ গ্রাম ওজনের সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৪০ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা—৬ বিজিবি ব্যাটালিয়ন উদ্ধার করেছে সাড়ে আট কেজির বেশি। বাকিটুকু আটক করেছে ৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়ন। ১ জানুয়ারি থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ৮ কেজি ৫৭২ দশমিক ৬৩ গ্রাম ওজনের অবৈধ সোনা উদ্ধার করেছে। উদ্ধারকৃত সোনার মূল্য ৯ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার ৫৩৫ টাকা। মূলত কম খাটুনিতে বেশি রোজগারের আশায় এখানে অনেকেই অবৈধ সোনা পাচারের কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তবে সীমান্তে বিজিবি কঠোর নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু গণ—অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন ও এর পরবর্তী অস্থিতিশীলতাসহ নানাবিধ ইস্যুতে আইন—শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বড় একটি অংশকে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। ফলে সীমান্তে পাচারকালে এখন সোনা ধরা পড়েছে কম। বর্তমানে সারা দেশে এখন সোনা চোরাচালানের ৬৩১টি মামলা নিয়ে তদন্ত চলছে। সোনা পাচারের গডফাদারদের বিরুদ্ধে ২১টি মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। তবে বছরের পর বছর পার হলেও ওসব মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানান, যেকোনো ধরনের চোরাচালানই দণ্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশ পুলিশ সোনাসহ সব ধরনের চোরাচালানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com