এফএনএস : ঈদ এলেই শহরে বসবাসকারী নাগরিকরা ছুটে যান পরিবার-পরিজনের কাছে। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে টানা দুই বছর স্বজনদের কাছ থেকে মানুষকে বিছিন্ন থাকতে হয়েছে। এবার পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় বাড়ি ফেরা মানুষদের চাপ বাড়বে সড়কে। এতে যে যানজট তৈরি হবে তার ভোগান্তি নষ্ট করে দিতে পারে আনন্দ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদযাত্রা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে তীব্র যানজটের কারণে। জানা গেছে, ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে বিআরটি প্রকল্পের কারণে রাস্তার বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ আর নির্মাণ সামগ্রী রাখায় স্বাভাবিক সময়েই যানজট লেগে থাকে। এরসঙ্গে ঈদ উপলক্ষে যানবাহনের বাড়তি চাপ যোগ হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা যাত্রী-চালকদের। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এদিকে, দুর্ভোগ আর ভোগান্তির অপর নামে পরিণত হয়েছে উত্তরা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা। বছরের পর বছর ধরে চলা ধীরগতির বিআরটি প্রকল্পের কারণে এ পথের যাত্রীরদের নাভিশ্বাস ওঠে। যদিও গত কয়েক মাসে দৃশ্যপটে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। গতি এসেছে প্রকল্পের কাজে। কিন্তু ঈদে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে এসব উদ্যোগ কতটা কাজে আসবে? যাত্রীরা বলছেন, অপরিকল্পিত কাজের কারণে তাদের দুর্ভোগ কয়েকগুণ বেড়েছে। যাত্রীদের মতে, এ কাজগুলো অতি দ্রুত সম্পন্ন হলে সবার জন্য ভালো হবে। অন্যদিকে এবার ঈদযাত্রায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা করছেন মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের চালকরা। কেননা, এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি মহাসড়ক সংস্কার ও প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজ। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে পারেন ঈদে ঘরমুখো মানুষ। সিরাজগঞ্জের মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, নাটোর, খুলনা, কুষ্টিয়াসহ উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলার পরিবহন চলাচল করে। স্বাভাবিক সময়ে দিনে গড়ে অন্তত ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করে এই মহাসড়কে। তবে যে কোনো উৎসবের আগে যানবাহন চলাচল দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে এ মহাসড়কের সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজ। ফলে মহাসড়কের মুলিবাড়ী, কড্ডার মোড়, নলকা, পাঁচিলিয়া, হাটিকুমরুল, ঘুড়কা, চান্দাইকোনা এই ৭টি পয়েন্টকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই স্থানগুলোতে সংস্কার কাজের জন্য সরু হয়েছে মহাসড়ক। এই মহাসড়কে দুই লেনের যানবাহন চলাচল করছে এক লেন দিয়ে। যে কারণে যানবাহনগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলাচল করতে পারছে না। ফলে প্রায়ই সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। চালকরা বলছেন, মহাসড়কের সংস্কার কাজ শেষ করার পাশাপাশি নলকা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে না দেয়া হলে ঈদে সৃষ্টি হতে পারে ভয়াবহ যানজট। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতার হোসাইন লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক এখলাক উদ্দিন বলেন, আমরা দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছি। দুর্ভোগ কমাতে ঈদের আগেই যানবাহন চলাচলের জন্য নলকা সেতু খুলে দেয়া হবে। সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী দিদারুল আলম জানান, আগামী ২০ রমজানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোসহ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সংস্কার কাজ শেষ করা হবে এবং মহাসড়ক চলাচলের উপযোগী করা হবে। হাইওয়ে পুলিশ বগুড়া রিজিয়ন পুলিশ সুপার মুনশী শাহবুদ্দিন বলেন, যানজট নিরসনে হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশ যৌথভাবে কাজ করবে। যানজট নিরসনে অবশ্যই বাড়তি ব্যবস্থা নেয়া হবে, কেউ যেন ভোগান্তির শিকার না হন, সবাই যেন নিবিঘেœ পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারেন। এদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ গ্রামের বাড়ি যাবে। আগামী ২৫ রমজান থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত দুপুরের পর থেকে গভীর রাত অবধি রাজধানী অচল হয়ে যেতে পারে। যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনে সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এবারের ঈদযাত্রায় রাজধানীবাসী যানজটের কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়বে। তাই এই মুহূর্ত থেকে রাজধানীর সব ফুটপাত, রাস্তা হকার ও অবৈধ পার্কিংমুক্ত করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে দাবি জানান তিনি। মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের প্রবেশদ্বারগুলো বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, বাবুবাজার ব্রিজ, পোস্তগোলা, টঙ্গী রেলস্টেশন, শহীদ আহসান উলাহ মাস্টার উড়ালসেতু, মীরের বাজার, উলুখোলা, কাঞ্চন ব্রিজ, গাবতলী মাজার রোড, মীরের ধৌর, আশুলিয়া, ইপিজেড, চন্দ্রা, রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু, জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ, হাতিরঝিল, মহাখালী, রামপুরা, শেখের জায়গা, আমুলিয়া, ডেমরা, সুলতানা কামাল ব্রিজ, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর, মদনপুর, মেঘনা টোল, ভুলতা, গাউছিয়া, বরফা অন্যদিকে বিআরটি নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যাতায়াতে মানুষকে অসহনীয় যানজটে পড়তে হবে। এসব যানজট নিয়ন্ত্রণে রাস্তার মোড় পরিষ্কার রাখা ও ছোট যানবাহন বিশেষ করে রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক প্রধান সড়কে চলাচল বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান। তা না হলে আগামী ২৫ রমজান থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত দুপুরের পর থেকে গভীর রাত অবধি রাজধানী অচল হয়ে যাবে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান। তিনি মনে করেন, এবার চাহিদা বেশি হওয়ায় সড়কের ব্যবস্থাপনা কোমায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হাদিউজ্জামান বলেন, দুর্ঘটনা গবেষণাকেন্দ্রের ২০১৮ ও ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, ১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ ঈদের সময় বাড়িতে গেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত দুই বছরে চার ঈদে মানুষ গ্রামে কম গেছে। তথ্য বলছে, প্রতি ঈদে কমপক্ষে ৬০ লাখ মানুষ গ্রামে গেছেন। আমাদের চলমান একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঈদের আগে চার দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন। এ সময় প্রতিদিন বাসে ৮ লাখ, ট্রেনে ১ লাখ, লঞ্চে দেড় লাখ, ব্যক্তিগত গাড়িতে প্রায় ৪ লাখ, মোটরসাইকেলে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়তে পারবেন। বাকি প্রায় ১২-১৩ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বে ট্রাক, ট্রেনের ছাদে করে। তখন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। হাদিউজ্জামান আরও বলেন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ২০ রমজানের পর বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবারের সদস্যরা, যাদের কাজ নেই, তাদেরকে ২০ রমজান থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। যাঁরা কর্মজীবী, ছুটি পেলে তাঁরা পরে যাবেন। তাহলে কিছুটা স্বস্তি মিলতে পারে। অন্যদিকে আসন্ন ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তি কমাতে বিভিন্ন সড়কে চলমান সংস্কার ও নির্মাণ কাজ ঈদের আগে ও পরে ১৪ দিন বন্ধ রাখার আহŸান জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। এফবিসিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত সভায় সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, বিভিন্ন সড়কে সংস্কার ও নির্মাণ কাজ চলায় যানবাহনের গতি ধীর হয়ে যায়; যা দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি করে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি কমাতে তাই ২৭ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সব ধরনের সংস্কার ও নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার আহŸান জানাই। ওই কয়েকদিন যেসব পয়েন্টে বেশি যানজট হয়, সেখানে সার্বক্ষণিক হাইওয়ে পুলিশ মোতায়েনের আহŸান জানান তিনি। মহাসড়কে চলাচলকারীদের অভিমত- ঈদের আগে যানজটের ভোগান্তি নিরসনে সব বিভাগের সমন্বয় থাকলে যানজট নিরসন করা সম্ভব। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের ডিসি আব্দুলাহ আল মামুন বলেন, অঞ্চলভেদে গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য যদি রিজার্ভ বাস করা যায়, তাহলে তারা একটা গার্মেন্টস থেকে তিন-চারটা বাসে করে যেতে পারবে। তাহলে ২০ লাখ শ্রমিক একই সময়ে রাস্তায় আসবেন না, প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবেন না। ঈদের ছুটিতে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই এই সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে আগাম প্রস্তুতি না নিলে ঈদে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেন নগরবিদরা।