এফএনএস : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে রথে বিচরণ করছিল দুর্বার গতিতে করোনা মহামারীর ধাক্কায় তা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গতি হয়ে গেছে শ্লথ। অর্থনীতির লোকসানকে পুনরুদ্ধারের কোন বিকল্প পথ নেই। কিন্তু এই পুনরুদ্ধারের পথেও নতুন নতুন বাধা এসে হাজির হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় বাধা হলো মূল্যস্ফীতি। বিশ্ববাজারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর। জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণায় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে উৎপাদন ও সেবা খাতের ব্যয়। উভয় খাতের এই ব্যয় বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। পাশাপাশি করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের উর্ধ্বগতির কারণে বিশ্ববাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি হলে শেষ পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও কঠিন হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের নিত্যপণ্যের বাজার বলতে গেলে এখন সাধারণ মানুষের কাছে নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবকিছুর দাম উর্ধ্বমুখী। বিশেষকরে তেলের দামে সাধারণ মানুষ নাকাল। এর ওপর আছে আবার জ¦ালানির দাম বৃদ্ধি। জ¦ালানির দাম বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে-এমনটি পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি আরও বলেছে, ‘যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, জ¦ালানি আমদানিকারক দেশগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলবে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি বৈশ্বিক মন্দা থেকে পুনরুদ্ধারকেও জটিল করে তুলতে পারে।’ ওমিক্রনের এই উর্ধ্বগতিতেও বিশ্বের কোন দেশে লকডাউন দেখা যাচ্ছে না। লকডাউনের কথা ভাবছে না বাংলাদেশও। এটি একটি স্বস্তিদায়ক ব্যাপার। লকডাউনে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে নতুনকরে লকডাউন দেওয়া মানে অর্থনীতির কোমর ভেঙ্গে দেওয়া। অনেকেই মনে করছেন বিশ্ব অর্থনীতি এখন উত্তরণের পথে। এই উত্তরণ বা ঘুরে দাঁড়ানো সকল দেশের জন্য সমহারে হবে কিনা এই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। করোনা পরবর্তী অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বে নানা ধরনের আলোচনা চলমান। যাতে বিশ্বের সকল দেশ একটি ভারসাম্যময় অর্থনীতিতে বিরাজ করতে পারে। তাহলেই হবে সব মানুষের মঙ্গল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতি উত্তরণের পথে থাকলেও প্রবৃদ্ধি সমভাবে হবে না। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, বিশ্বে আবার ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ পরিস্থিতির মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এটি এমন এক অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে কোন অর্থনীতি একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি হার বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়া ও বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। ফলে আমাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে যা আমাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যা সাধারণ মানুষের জন্য তাদের জীবন জীবিকা সচল রাখতে অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। একে অর্থনীতির জন্য খুব খারাপ সময় হিসেবে বিবেচিত করা হয়। কারণ এ সময় মূল্যস্ফীতি কমাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য হিমশিম খেতে হয় এবং একে নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ নয়। যার জন্য ধনী দেশগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে গরিব দেশগুলো যেন কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এটি কারও অজানা নেই যে ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী পদ্ধতি অনুসরণ করে। দেখা যায় এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণত ঋণের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি করে। ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে যায় এবং বিনিয়োগও ব্যয়বহুল হয়। অর্থাৎ বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, বিনিয়োগ হ্রাস পায়। আর বিনিয়োগ হ্রাস পেলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি কম হয়। ফলে অর্থনীতি বিশাল ধাক্কা খায় এবং মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয়। মূলত করোনা মহামারীতে বিশ্ব অর্থনীতি তীব্র চাপের মধ্যে পড়েছে। উৎপাদন কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যায় ভুগছে বিশ্ব অর্থনীতি। এশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো উচ্চমূল্যস্ফীতির সমস্যায় পড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এর প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে রয়েছে। বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। শুধু বাংলাদেশ নয় মূল্যস্ফীতির উলম্ফনে দারুণভাবে ভুগছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। এ ছাড়া জানা যায়, ১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে কানাডায়। জার্মানির মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ২৯ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে। মূল্যস্ফীতির এ হার ১৯৯২ সালের জুনের পর সর্বোচ্চ। অক্টোবরেও দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ভোক্তা মূল্যসূচক সেপ্টেম্বরের ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে বেড়ে অক্টোবরে হয়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। টানা তিন মাস এই সূচক বাড়ছে। সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে মূল প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি, যা অক্টোবরে গত ৬২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে, যেটি এর আগের মাসে ছিল ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর আগে সর্বশেষ ২০১৬-এর আগস্টে এই সূচকের মান ৭ শতাংশ ছিল। এরপর এবারই প্রথম খাদ্য নয়-এমন পণ্যের মূল্যস্ফীতি এতটা বাড়ল। তবে আশাব্যঞ্জক সংবাদ এই যে, স¤প্রতি রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এই সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করেছে ১ লাখ ২৬৭ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয় ৮৭ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। তবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ হাজার ৯৮ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। এ সময়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল। তবুও করোনা পরিস্থিতিতে এই রাজস্ব আয়কেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে রাজস্ব আদায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি বাড়ছে। পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মনিটরিং ব্যবস্থাও জোরদার করা হচ্ছে। সবকিছু চলমান থাকলে, ওমিক্রনের ক্ষতিকর প্রভাব যদি অর্থনীতিতে না পড়ে তাহলে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি সংকট কাটিয়ে উঠতে এটি সাহায্য করবে বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।