বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০২:৪৯ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
খুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য সম্পদের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় শীর্ষক সেমিনার নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে দুস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান সাতক্ষীরায় সম্প্রীতি এইড ফাউন্ডেশন অবহিতকরন সভা অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক এমপির সাথে সাতক্ষীরা পৌর কর্তৃপক্ষের মতবিনিময় আমি একা নই, চেয়ারম্যান হবে সদর উপজেলার ৪ লক্ষ ভোটার: মশিউর রহমান বাবু আশাশুনি খাদ্য গুদামে অভ্যন্তরিণ বোরো সংগ্রহ উদ্বোধন এবিসি কেজি স্কুলে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর মাজারে কেশবপুরের নব-নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান মফিজের শ্রদ্ধা জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত সাতক্ষীরায় এলজিইডির ন্যাশনাল টেন্ডারস ডাটাবেজ বিষয়ক ওয়ার্কশপ

‘মে দিবস’ শ্রমিকদের মর্যাদা ব্যতীত দেশ-জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বুধবার, ১ মে, ২০২৪

প্রফেসর মো. আবু নসর
আজ মহান ও ঐতিহাসিক মে দিবস। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক দিবস হিসেবে ১মে সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ পালিত হয়। ১মে দিবসের একটি ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। ঐতিহাসিক ও মহান ‘মে দিবস’ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন। দেশ ও জাতির উন্নয়নে শ্রমিকদের মর্যাদা অতি আবশ্যক। শ্রমিকদের মর্যাদা ব্যতীত দেশ ও জাতির উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়। ঊনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না কোন ন্যায্য মুজুরির নিশ্চয়তা, ছিল না নির্দিষ্ট সময়ের সীমা পরিসীমা। মালিকরা তাদের খেয়াল খুশি মতো শ্রমিকদের ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত খাটাতো। ১৮৭৭ সালে ন্যায্য মুজুরী, ৮ ঘন্টা কর্ম দিবস ও অন্যান্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকরা ব্যাপক ধর্মঘট পালন করে। আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয়। গুলিতে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত ৩০০ শ্রমিক আহত হয়। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে’ তে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অগনিত শ্রমজীবি মানুষ শ্রমিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন এক দূর্বার আন্দোলন। সেই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১ হাজার ৫৬২টি শিল্প কারখানাসহ সব শিল্পঞ্চলে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘাটের ডাক দেয় শ্রমিকরা। শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভের সমুদ্রে। শহরের ৩ লক্ষাধিক মেহনতি শ্রমিক কাজ বন্ধ রেখে লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে নেমে আসে রাস্তায়। এসময় আন্দোলনরত ক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের উপর বিনা উস্কানিতে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে ওই দিনই নিহত হন ১০জন শ্রমিক, আহত হন হাজার হাজার শ্রমিক। তবুও অব্যাহত থাকে ধর্মঘট ও আন্দোলন। এরপর ৩মে রিপার কারখানার সামনে শ্রমিক সভায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আরো ৬ শ্রমিক। এসব হত্যার প্রতিবাদে ৪মে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেট স্কয়ারে স্মরণাতীতকালের বিশাল শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে আবারো বর্বরোচিত হামলা চালায় পুলিশ। ওই ঘটনায় ৪জন শ্রমিক ও ৭জন পুলিশ নিহত হয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় বহু শ্রমিককে। গ্রেফতারকৃত ৬জন শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। কারাগারে বন্দিদশায় আত্মহনন করেন এক শ্রমিক। কারাগারে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয় হাজার হাজার শ্রমিককে। দাবি আদায়ের জন্য সেদিন শ্রমিকদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল শিকাগোর রাজপথ। ‘হে’ মার্কেটের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত প্রতিরোধ যুদ্ধে এবং আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দৈনিক কাজের সময় ৮ঘন্টা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় সম্ভব হয়। দীর্ঘদিন বঞ্চনা আর শোষন থেকে মুক্তি পেতে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের এই দিনে শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঝরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন এক অপার উপখ্যান। অবশেষে দৈনিক ৮ঘন্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় তৎকালিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২য় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘১মে’ কে ঘোষনা করা হয় ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে ‘মে দিবস’। এক অর্থে সকল শ্রমজীবী মানুষকে শ্রমিক বলা যেতে পারে। শুধু পরিবহন, পোশাক কিংবা শিল্প কলকারখানায় কাজ করা নিচের পদের মানুষকে শ্রমিক হিসেবে গণ্য না করে সকল কায়িক পরিশ্রম করা মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে দেখা যেতে পারে। হোক সে দিনমজুর কিংবা চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ী। সকলেই শ্রম দিচ্ছে যার যার স্তরের শ্রমিক হিসেবে। শ্রমিক শব্দটি কোন ভাবেই এককেন্দ্রিক হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। সমাজের নিচ থেকে উপরমহল পর্যন্ত স্ব-স্ব পেশায় সকলকেই শ্রমিক বলা যেতে পারে। আমাদের দেশেও যথাযোগ্য মর্যাদাও গুরুত্ব সহকারে ‘মে দিবস’ পালিত হয়ে আসাছ। কিন্তু আজো শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণ সুনিশ্চিত হয়নি। শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত শিল্পের বিকাশও সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ৯০এর দশকের পরে যেসকল ভয়াবহ দুর্ঘটনায় হাজারো মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো মূলত বিভিন্ন শিল্প-কারখানাকেন্দ্রিক। তন্মেধ্যে- ২০০৫ সালে ১১এপ্রিল সাভারের পলাশবাড়ির শাহরিয়ার ফেব্রিক্স ইন্টাস্ট্রিজ লি. ও স্পেকট্রাপ সোয়েটার ইন্টাস্টিজ লি. এর ভবন ধ্বসে ৬২জন শ্রমিকের মৃত্যু, ২০১০ সালে ১জুন ঢাকার তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ভবন ধ্বসে ২৫জনের মৃত্যু হয়। ২০১০ সালের ৩জুন ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলিতে অগ্নিকান্ডে মারা যান ১২৪জন, আহত হন কয়েকশত। ২০১০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের তল্লা এলাকায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৩৪জন মুসল্লি। তাদের মধ্যে অনেক শ্রমিকও ছিলেন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর তাজরিন পোশাক কারখানায় অগ্নিকান্ডে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ১১২জন, সেসময় আহত হন ১৪১জন। ২০১৩ সালের ২৪এপ্রিল বাংলাদেশের সাভারের রানা প্লাজা ভবন ও পোশাক তৈরী কারখানা ভবন ধ্বসে পড়ে। এতে ভবনের ৫টি পোশাক কারখানার ১১৩৮জন শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন সহস্রাধিক শ্রমিক। তাদের মধ্যে অঙ্গ হারান ২৭জন। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজিপুর টাম্পকোয় টঙ্গীপুর বিসিক শিল্প নগরী এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডে নিহত হন ৩৯জন, আহত হন ৩৫জন। ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার চকবাজারে চুরিপট্টির অহেদ মেনশনে অগ্নিকান্ডে মারা যান ৭১জন, আহত হন অনেকে। ২০২১ সালের ৮জুলাই বৃহষ্পতিবার বিকাল পৌনে ৬টার দিকে নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে পরদিন ৯জুলাই শুক্রবার দুপুর ১২টায়। ওই ঘটনায় নিহত হন ৫২জন শ্রমিক। পুরাতন ঢাকার চকবাজার ও বনানীর বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ডে শ্রমিকসহ অনেকের প্রাণহানির মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা আজো আমাদের নিদারুনভাবে শোকাহত ও বেদনাহত করে তুলেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ¦বর্তী সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুর, খুলনা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন করাখানায় অগ্নিকান্ড, ভবন ধ্বসসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। অনুরূপভাবে বিভিন্ন সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবি, লঞ্চঅগ্নিকান্ড ও নানান শ্রমপেশার দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি স্ব-স্ব পেশার শ্রমিকদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তাই আজ নিহত ও আহত সকল শ্রমিকদের প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা, সহমর্মিতা ও সহানুভুতি জ্ঞাপন অনস্বীকার্য ও অপরিহার্য। বস্তুত: বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতির মূলে আছেন এ দেশের সৃজনশীল গরীব শ্রমিক। শ্রমিকদের জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া যেমন কারোরই কাম্য নয় তেমনি সকলের শ্রমিকবান্ধব হওয়াও বাঞ্চনীয়। পরিবহন শ্রমিক, পোশাক শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার শ্রমিকসহ ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল কর্মযজ্ঞতায় নিয়োজিত সকল শ্রমিকদের সামগ্রিক স্বার্থ ও সঠিক মর্যাদা রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট মালিক পক্ষকে সকল গাফিলতির উর্দ্ধে উঠে এসে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী প্রদানসহ শ্রমিকসেবা নিশ্চিত ও তরান্বিত করা একান্ত প্রয়োজন। তবেই হবে মহান ও ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ এর অঙ্গীকার পূরণ এবং ‘মে দিবস’র যথার্থতা ও স্বার্থকতা।
লেখক:
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয় সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা।
মোবাইল নং- ০১৭১৭-০৮৪৭৯৩

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com