এফএনএস বিদেশ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘টাইটানিক’ দর্শকের মনে অন্তিম সময়ে যে আতঙ্ক জুড়ে দিয়েছিল তার ভার এখনো বহন করছে সমুদ্রের ওই অংশটি। বাস্তবেই জায়গাটি নানা কারণে বিপজ্জনক। পুরো পৃথিবীর সমুদ্র-ভাগ এখনো নানা কারণে বিপদসংকুল হয়ে আছে। ওই অঞ্চলে এখনো নৌযান চলাচল যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রের তলদেশে অভিযান পরিচালনা করা। কেন তা ঝুঁকিপূর্ণ তা একবার জানা দরকার। ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বেশ মজার মিশেল রয়েছে এক্ষেত্রে। ১৯১১ সালের কথা। শরতেরই কোনো এক সময়ে গ্রিনল্যান্ডে বিশাল বরফ-স্তরের দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি হিমবাহ থেকে বিকট শব্দ তুলে বরফের বিশাল এক খÐ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সমুদ্রের ঘনত্বের কারণে বরফ খÐটি ভাসতে থাকে। এগিয়ে যেতে শুরু করে দক্ষিণের দিকে। সমুদ্রের ¯্রােত আর বাতাসের ধাক্কায় অত বড় বরফ আর টিকে থাকতে পারে না। আস্তে আস্তে গলতে শুরু করে। এক বছর পর অর্থাৎ ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল শীতল এক রাতের ঘটনা। ওইদিন আকাশে নেই চাঁদ। চারদিকে সমুদ্রের আওয়াজ আর ভয়াবহ ঠাÐা। ১২৫ মিটার (৪১০ ফুট) দীর্ঘ ঐ আইসবার্গটির সঙ্গে যাত্রীবাহী জাহাজ আরএমএস টাইটানিকের ধাক্কা লাগে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ইংল্যান্ডের সাদাম্পটন থেকে ছেড়ে জাহাজটির সেটি ছিল প্রথম সমুদ্র যাত্রা। সংঘর্ষের তিন ঘণ্টার মধ্যে জাহাজটি ডুবে যায়। ১৫০০’রও বেশি যাত্রী এবং জাহাজের ক্রু ঐ ঘটনায় প্রাণ হারায়। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ এখন ক্যানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড উপক‚ল থেকে প্রায় ৪০০ মাইল (৬৪০ কিলোমিটার) দক্ষিণ-পূর্বে এক জায়গায় রয়েছে। এখানে সাগরের গভীরতা প্রায় ৩.৮ কিলোমিটার (১২,৫০০ ফুট)। একটি বরফ খÐই যে এত বড় দুর্ঘটনার মূল কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওই অঞ্চলে এখনও বরফ খÐ ভেসে আসে। অর্থাৎ ওই এক বরফ খÐই সমস্যা নয়। আরো অনেক বরফ খÐ সেখানে আছে। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে আগস্ট মাসেই ১৫১৫টি আইসবার্গ দক্ষিণ দিকে ভেসে আটলান্টিক সাগরে জাহাজ চলাচলের পথে ঢুকে পড়েছিল। এ তো গেলো ওপরের কথা। এই অঞ্চলের সমুদ্রের তলদেশে অভিযান পরিচালনা আরও বড় প্রতিবন্ধকতার সামনে ফেলে দিতে পারে। প্রথমত সমুদ্রের নিচে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। তাই নির্দিষ্ট সীমানার পর আইসবার্গের আড়ালে অন্ধকার। সাগরের পানি সূর্যালোক শোধন করে প্রায় ১০০০ মিটার-এর চেয়ে গভীরে যেতে পারে না। সাগরের নিচে তাই অতল অন্ধকার। টাইটানিক যেখানে ডুবেছে সে জায়গাটি ‘মিডনাইট জোন’ নামে অধিক পরিচিত। এবার আসা যাক সা¤প্রতিক ঘটনায়। যারা ডুবোজাহাজ নিয়ে সেখানে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়েছিল তাদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বিষয় জানা গেছে। সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দু’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সাগরের গভীরে নামার পর সাবমার্সিবলের আলোর নিচে হঠাৎ করেই সমুদ্রের তলদেশ এবং টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাঠামো ফুটে ওঠে। একটি ট্রাকের সাইজের সমান সাবমার্সিবলের লাইটের আলোতেও কয়েক মিটারের বেশি দেখা যাবে না! সঙ্গত কারণেই দিক হারানোর সম্ভাবনা থাকে বেশি। একারণে এরকম গভীরতায় ডুবোযান পরিচালনা করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। গত কয়েক দশক ধরে হাই রেজোলিউশন স্ক্যানিং করে টাইটানিকের ধ্বংসস্থলের একটি বিশদ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এটি ব্যবহার করে কোথায় কী আছে তা দেখা যায়। এছাড়া, সঙ্কেত পাঠানোর যেসব যন্ত্র বসানো হয়েছে তা ব্যবহার করেও সাবমার্সিবলের ক্রুরা দৃষ্টিসীমার বাইরে বিভিন্ন বস্তু এবং টাইটানিকের খোলের বিভিন্ন দিক সনাক্ত করতে পারেন। ডুবোজাহাজ চালকরা ‘ইনারশিয়াল ন্যাভিগেশন’ নামেও একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এতে অ্যাক্সিলোমিটার এবং জাইরোস্কোপের সাহায্যে তাদের অবস্থান এবং দূরত্ব শনাক্ত করা যায়। ওশানগেট কোম্পানির টাইটান সাবমার্সিবলটিতেও একটি অত্যাধুনিক ইনারশিয়াল ন্যাভিগেশন সিস্টেম রয়েছে, যা সমুদ্রের তলদেশে ডুবোযানটির গভীরতা এবং গতি পরিমাপ করতে পারে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকার পরও সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকার এবং গভীরতাকে ভালোভাবে যুঝতে পারার সক্ষমতা এখনও আমাদের তৈরি হয়নি। তাছাড়া আরেকটি গোপনীয় চোরা¯্রােতের কারণেও এখানে অভিযান পরিচালনায় সমস্যা রয়েছে। সমুদ্রবিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘বেন্থিক স্টর্ম’। সমুদ্রের তলদেশেও পানির চোরা¯্রােত অনেক সময় পানি এদিক-সেদিক করে নেয়। আর এই এদিক-সেদিক করে নেওয়াও ডুবোজাহাজ পরিচালনায় সমস্যা করে। তাহলে কেমন আছে টাইটানিক? ১০০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এতদিন পর টাইটানিক পুরোপুরি ক্ষয়ে যাওয়ার কথা। শুরুর দিকে ডুবে যাওয়ার পর জাহাজের দুটি প্রধান অংশের সঙ্গে যখন সমুদ্রতলের সংঘর্ষ ঘটে তখন এর বড় অংশগুলি বিকৃত হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া জীবাণু জাহাজের লোহা খেয়ে ফেলে বরফের আকৃতির ‘রাস্টিকল’ তৈরি করে ও ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, জাহাজটির পেছনের অংশে ব্যাকটেরিয়ার তৎপরতা বেশি, কারণ ঐ অংশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি। জাহাজের সামনের দিকের তুলনায় এটি ৪০ বছর আগে ক্ষয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা সাগরতলে পলির প্রবাহের ফলে টাইটানিক একদিন পলিচাপা পড়ে যাবে।