আফগানিস্তানের ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজের ক্রিকেটার হওয়ার পথ সহজ ছিল না। ক্রিকেট খেলার জন্য তাকে গোপনে কাজ করতে হয়েছে, নিজের উপার্জনে ব্যাট কিনতে হয়েছে, আবার সেই ব্যাট তার ভাই ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন তিনি আফগানিস্তানের অন্যতম সেরা ব্যাটার, আইসিসি ওয়ানডে ব্যাটিং র্যাঙ্কিংয়ে অষ্টম এবং টি—টোয়েন্টিতে ১৫তম স্থানে আছেন। খোস্ত প্রদেশে জন্ম নেওয়া গুরবাজ ছোটবেলায় ফুটবল খেলতেন। তবে টিভিতে ক্রিকেট দেখে এই খেলার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। কিন্তু তার পরিবার চায়নি তিনি ক্রিকেটার হন। তার বাবা, যিনি একজন স্কুলের প্রধান শিক্ষক, চেয়েছিলেন গুরবাজ ডাক্তার বা প্রকৌশলী হোক। গুরবাজও পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, তবে ষষ্ঠ শ্রেণির পর ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে যান। একদিন বাড়িতে অনেক অতিথি এলে তার ভাই তাকে চা আনতে বলেছিলেন। কিন্তু পথে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে চা আনার কথা ভুলে যান গুরবাজ। তার ভাই রেগে গিয়ে তার ব্যাট ভেঙে ফেলেন। পরিবারের কেউই তার ক্রিকেট খেলা সমর্থন করছিল না। যেহেতু পরিবার থেকে ক্রিকেট খেলার জন্য অর্থ সাহায্য পাননি, তাই গুরবাজ গোপনে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের বাড়ি তৈরি করার সময় তিনি একজন ঠিকাদারের অধীনে কাজ শুরু করেন। তবে শর্ত ছিল, তার বাবা ও ভাই যেন জানতে না পারেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি ঠিকাদারকে বলেছিলাম, যদি কাউকে ১০ ডলার দাও, আমাকে ৫ ডলার দাও। কিন্তু আমার পরিবারের কাউকে বলো না। আমি কঠোর পরিশ্রম করব।’’ মাত্র ১৬ দিনের কাজ করেই তিনি নিজের জন্য একটি ব্যাট এবং গ্লাভস কিনতে সক্ষম হন। কিন্তু তার ভাই আবার তা ভেঙে ফেলেন। পরে তার ভাই বুঝতে পারেন, গুরবাজ সত্যিই ক্রিকেটের প্রতি নিবেদিত এবং ধীরে ধীরে তাকে সমর্থন করতে শুরু করেন। যখন গুরবাজ ১৫ বছর বয়সে আফগানিস্তান অনূর্ধ্ব—১৯ দলে নির্বাচিত হন, তখনও তার নিজের ব্যাট ছিল না। ভারতের বিপক্ষে একটি ম্যাচের আগে তিনি অন্য খেলোয়াড়দের কাছে ব্যাট ধার চাইছিলেন। কিন্তু অনেকে দিতে চায়নি, কারণ সবাই মাত্র একটি ব্যাট নিয়ে খেলত। অবশেষে একটি ভাঙা ব্যাট জোগাড় করেই মাঠে নামতে হয়েছিল তাকে। ১৬ বছর বয়সে শপাগিজা ক্রিকেট লিগে মিস আইনাক নাইটসের হয়ে অভিষেক হলেও প্রথম দুই ম্যাচে শূন্য রান করে আউট হন। তবে এরপর তার প্রতিভা ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে এবং জাতীয় দলে জায়গা করে নেন। ২০২১ সালে ওয়ানডে অভিষেকে সেঞ্চুরি করে ইতিহাস গড়েন গুরবাজ। এরপর বিপিএল, লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ ও আইপিএলে খেলে নিজের স্কিল উন্নত করেছেন। ২০২৩ আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে ১১ ম্যাচে ২২৭ রান করেন। ২০২৪ সালে তাকে বেঞ্চে রাখা হলেও তিনি প্রতিদিন অনুশীলন চালিয়ে যান। এর ফল পান টি—টোয়েন্টি বিশ^কাপে, যেখানে তিনি আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। আফগানিস্তান ২০২৩ ওয়ানডে বিশ^কাপে সেমিফাইনালের খুব কাছে গিয়েও জায়গা পায়নি। তবে টি—টোয়েন্টি বিশ^কাপে তারা শেষ চারে উঠে ইতিহাস গড়ে। গুরবাজ মনে করেন, তারা এখন আর বড় দলগুলোর থেকে পিছিয়ে নেই। ‘‘আমরা এখন যে কোনো দলের বিপক্ষে, যে কোনো কন্ডিশনে জিততে পারি।’’ গুরবাজ মনে করেন, ক্রিকেটই আফগান জনগণের একমাত্র আনন্দের উৎস। ‘‘যখন আমরা ম্যাচ জিতি, তখন মানুষ ঈদের মতো উদযাপন করে। তাই আমরা কঠোর পরিশ্রম করি, কারণ আমরা তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই।’’ একসময় যার পরিবার ক্রিকেট খেলতে দিত না, তারাই এখন তার সবচেয়ে বড় ভক্ত। ২০২২ সালে শপাগিজা লিগে তার এক ভাই গ্যালারি থেকে তাকে বলেছিলেন, ‘‘সাবধানে খেলো, নিশ্চিত করো সেঞ্চুরি করছ!’’ গুরবাজের স্বপ্ন এখন আরও বড়। আফগানিস্তানকে একটি বড় শিরোপা জেতানোই তার পরবর্তী লক্ষ্য।