এফএনএস : ভিসি পদ এখন হয়ে গেছে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। এজন্য দেখা যায় শিক্ষক হিসেবে ভিসিদের যতোটা মমত্ব থাকার কথা তাঁর চেয়েও তাঁদের মধ্যে বেশি দেখা যায় রাজনৈতিক দাপট। দেশের স্বায়ত্তশাসিত ৪টি ছাড়া ৫৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ দেয় সরকার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি নেই। এর ফলে উপাচার্য হওয়ার জন্য একজন শিক্ষকের প্রধান যোগ্যতা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পরিচয়, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বা আনুগত্য। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার কথা। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিমাত্রায় রাজনীতির চর্চা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু উপাচার্যরা সরকারের মনোনীত হয়ে নির্বাচনকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে স্বায়ত্তশাসিত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন কমপক্ষে ৬১ জন অধ্যাপক। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী নির্বাচিত হওয়ার কথা থাকলেও তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন অনির্বাচিত। অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষকের অভাবও তৈরি হয়েছে। অভিযোগ আছে, আশির দশকের শেষভাগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে মানের সঙ্গে আপোশ করা শুরু হয়। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের আড়ালে ভোটার নিয়োগ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে মেধাবীরা আসতে পারছেন না, অন্যদিকে শিক্ষকতার প্রতি মেধাবীদের একটি অংশও আর আকৃষ্ট হচ্ছেন না। এই নাজুক পরিস্থিতি তৈরির জন্য সমালোচিত ও বিতর্কিত উপাচার্যদের ভ‚মিকা রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার মেরুদন্ড নড়বড়ে। উচ্চশিক্ষার মান পড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক মর্যাদাক্রমে (র্যাংকিংয়ে) বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম না থাকা, দু-একটি নাম থাকলেও তা তলানিতে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য উপাচার্য না থাকা। দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্য অধ্যাপকদের উপাচার্য করা হচ্ছে না। যোগ্যদের অনেকে আবার ওই পদে যেতেও চান না। অনেকের ইচ্ছে থাকলেও রাজনৈতিক দৌড়ে পিছিয়ে পড়েন। আর এসব কিছু মিলিয়ে উপাচার্য পদ অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য বা অতিমাত্রায় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের কাছে চলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক মদতে গদিতে বসা উপচার্যের সাথে প্রায়শ ছাত্র-ছাত্রীদের বিরোধ লক্ষ্য করা যায়। কেননা উপাচার্যহওয়ার জন্য যে যোগ্যতা থাকার দরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব উপচার্যের মধ্যে তা থাকে না। শাবিপ্রবিতে উপাচার্যহটাও আন্দোলন এখন হট টপিক। দীর্ঘ দিনের অনশন বিক্ষোভের পরও উপাচার্যঅবশ্য তাঁর সাধের গদি ছাড়েননি। দেশের স্বনামধন্য লেখক ও শাবিপ্রবির শিক্ষক জাফর ইকবালের অনুরোধে অনশনরত ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের অনশন ভঙ্গ করেছেন। ঝড় থেমে যাওয়ার পর প্রকৃতিতে এক ধরণের শান্ত স্তব্ধ ভাব বিরাজ করে। প্রভোস্টের পদত্যাগ দাবি ও ভিসির পতন দাবি আন্দোলনে টানা ১৪ দিনের ঝড়ের শেষে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শান্ত নীরবতা বিরাজ করছে। ভিসির বাসভবনের সামনে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক অবরোধমুক্ত করে দেওয়া হলেও ভিসি অপসারণের প্রজ্ঞাপন জারির পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। জানা যায়, অনশন ভাঙার পর ৬ জন শিক্ষার্থীর শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ হওয়ায় তাদের আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে ৫জনের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে গতকাল সকালে তাদের বাসায় নিয়ে আসা হয়। একজন শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে যারা বাসায় এসেছেন তারা পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও সময় লাগবে। চিকিৎসকদের তত্বাবধানেই তারা আছেন। সূত্র জানায়, শাবিপ্রবিতে ঘটনার সুত্রপাত হয় জানুয়ারির ১৩ তারিখে। ওইদিন রাত আটটা থেকে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগ দাবির আন্দোলনে ১৫ জানুয়ারি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের হামলার পর আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। এরপর ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার পর থেকে আন্দোলন গড়ায় ভিসি পতনের এক দফা দাবিতে। ঘটনার দিন রাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলেও সে নির্দেশ অমান্য করে শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলে আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিবীদদের মধ্যস্থতার চেষ্টা উপেক্ষা করে আন্দোলন সর্বশেষ রূপ নেয় আমরণ অনশনে। অনশনের প্রায় এক সপ্তাহ পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হক অনশনকারীদের অনশন ভাঙান। অনশন ভেঙে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন ভিসি’র পতনের আগ পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে। এদিকে, শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন আছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অর্থসহায়তাকারী হিসেবে ৩৫৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সবাই শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র। প্রশাসন মনে করছে, শাবির এই আন্দোলন পুঁজি করে কোনো পক্ষ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার পাঁয়তারায় লিপ্ত ছিল। অবশ্য আদালত ইতোমধ্যে তাদের জামিন মঞ্জুর করেছেন। পুলিশ সূত্র জানায়, শাবিপ্রবির আন্দোলন জিইয়ে রাখতে অর্থসহায়তাকারী ৩৫৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা কেন এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে এত উৎসাহী ছিল তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। আন্দোলনটি কোনো সরকারবিরোধী চক্রান্তের অংশ কিনা, অর্থ জোগানের কারণ, অর্থ জোগান ও ইন্ধনদাতাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, গ্রেফতারকৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থ জোগানের কারণ এবং এই আন্দোলনে জামায়াত-বিএনপির মদদ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। উলেখ্য, উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকার অনুসন্ধান কমিটির (সার্চ কমিটি) মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে প্রাথমিকভাবে চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়কে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। ওই কমিটির মাধ্যমে তিনজন অধ্যাপকের একটি প্যানেল তৈরি করে তা আচার্যের কাছে পাঠানোর উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই প্রক্রিয়ায় তখন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগও পেয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সার্চ কমিটির কর্মকান্ড থেমে যায়। প্রজ্ঞাপন জারি করে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া ঠিক করা হলেও এটা বন্ধের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।