মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ১২:৫১ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
আশাশুনি খাদ্য গুদামে অভ্যন্তরিণ বোরো সংগ্রহ উদ্বোধন এবিসি কেজি স্কুলে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর মাজারে কেশবপুরের নব-নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান মফিজের শ্রদ্ধা জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত সাতক্ষীরায় এলজিইডির ন্যাশনাল টেন্ডারস ডাটাবেজ বিষয়ক ওয়ার্কশপ উপজেলা পরিষদের সেবা পৌঁছে দেবো জনগণের দোরগোড়ায়: মশিউর রহমান বাবু হাসছে সাতক্ষীরার আম বাজার ঃ চলছে কুলষিত করার হীনচেষ্টা ইসরাইল গাজা যুদ্ধে হারতে চলেছে ঃ প্রবল প্রতিরোধ হামলায় হামাস ভোমরায় বিজিবির অভিযানে স্বর্ণসহ আটক ১ গোদাঘাটা বারাকাতিয়ায় দাখিল মাদ্রাসায় চক্ষু শিবির উদ্বোধন

শীত মধু খেজুর রস আহরণে ব্যস্ত উপকূলের গাছিরা নতুন করে তৈরি হচ্ছে না গাছি নামক শিল্প

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

শাহজাহান সিরাজ, কয়রা থেকে ॥ ঠিলে ধুয়ে দে, বউ গাছ কাটতি যাব খাজুর গাছে চোমর বারোয়ছে তোরে আইনে দেব। সন্ধেয় রস পাইড়ে আইনে, জাউ রাইন্দে খাবো’ এই হলো খেজুর বৃক্ষকে কেন্দ্র করে তৈরি গাছি সম্প্রদায়ের বুলি। এমন কথার গান শীত এলেই কয়রা উপজেলার গ্রামাঞ্চলের মাঠেঘাটে শোনা যায়। তাদেরকে আবার শিবলিও বলা হয়। এরা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। শীত উপেক্ষা করে খেজুর রসে চুমুক দিতে ছোট বড় নানা বয়সীদেও ভিড়। এক ভাঁড় রস কিনে বাড়ির পথে গমন অতিথি আপ্যায়নে। বাংলার এমন চিত্র এখন আর দেখা মেলে না। এই সেই চোমর, আসলে তা খেজুরের ফুল। আগে মাঝে মধ্যে এসবের দেখা মিলতো। এর পরাগরেনু দিয়ে ছোটবেলায় পাউডার বানাতাম, কি সব আনন্দময় দিন ছিল। তাই শীতকালে এদের কদর বেড়ে যায়। গাছিরা গাছ তোলা চাছার জন্য দা, চোং, বা খিল, কাটি, দড়ি ভাঁড় ইত্যাদি জোগাড় করার জন্য ব্যস্ত থাকেন। শীতকালে গাছিদের কর্মসংস্থান হয়। একজন গাছি দৈনিক ৬০ থেকে ৭০ টি গাছ কাটতে পারেন। শত শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে জড়িয়ে রয়েছে খেজুরের রস,গুড় ও পাটালী। গাছি ও জ¦ালানি সংকটে কয়রার ঐতিহ্যবাহী সেই খেজুর গুড় হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ীরা খেজুর গুড়ে চিনি মেশানোর কারনে চিরচেনা সেই মিষ্টি স্বাদও আর থাকছে না। কয়রায় উপকূলে কৃষকরা নতুন ধান সংগ্রহের পাশপাশি খেজুর রস আহরনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। এখন চলছে খেজুর গাছের ডগা চাছার কাজ। এরপর ডগায় বাশের তৈরি বিশেষ খিল লাগিয়ে সংগ্রহ করা হবে ফোটায় ফোটায় রস। মাটির ভাঁড়ে খেজুর রস সংগ্রহ করা হয়। তবে আজকাল প্লাষ্টিকের বোতলেও খেজুর রস আহরণ করে চাষিরা। শীতের পুরো মৌসুম জুড়ে চলবে রস, গুড়, পিঠা-পুলি , পায়েস খাওয়ার পালা। আর কিছুদিন পর নতুন গুড়ের মিষ্ঠি গন্ধে ধীরে ধীরে আমোদিত হয়ে উঠে গ্রামে। যার মোন মাতানো স্বাদ ও ঘ্রাণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। খেজুর গাছের বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে যত বেশি শীত পড়বে তত বেশি মিষ্টি রস দেবে।শীতের সকালে খেজুর রস পান শরীর ও মনে প্রশান্তি এনে দেয়। আর খেজুর রসের পিঠা পায়েস বাংলার উপাদেয় খাদ্য তালিকায় এখনও জনপ্রিয়। খেজুর গুড় আবহমান বাংলার সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। খেজুরের নলের জ¦ালানো লাল রস ছাড়া শীত মৌসুমের পিঠা খাওয়া জমে না। খেজুর রস গ্রাম বাংলায় শত উৎযাপনের সাথে মিলে মিশে আছে। তবে খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহে গাছির অভাব দেখা দিয়েছে। সংকট রয়েছে নতুন গাছি তৈরিতেও। কয়রা সদরের মদিনাবাদ গ্রামের গাছি আবুল কালাম বলেন, আমি গাছ কাটছি ৪৪ বছর ধরে বয়স ৬০ বছর হলেও এ বছর তার এলাকায় গাছ কেটেছেন ৪০০ টির বেশি। সরেজমিনে তিনি প্রতিবেদককে জানান, একটা সময় আমাগের এলাকায় গাছ কাটতাম উৎসব করে। আমাগের দিকে আগে উত্তরাঞ্চল থেকে উত্তরি গাছি আসত অনেকজন মিলে তারা এখানে ৪ মাস বাসা বেধে থাকত আর গাছ কাটত। কিন্তু এখন গাছ তেমন না থাকায় তারা আসে না। আমি আমার ওস্তাদ যার কাছে আমি গাছ কাটা শিখেছি সেই নওয়াব আলীসহ মালেক, আফসার, নেছার সাত্তার সহ আরোও অনেকে। তবে সময়ের সঙ্গে কেউ পেশা বদলাইছে, আমার ওস্তাদ নওয়াব আলীসহ অনেকেই বা বেঁচে নেই। ফলে পুরান এই পেশা কাউকে ধরতে দেখিনি এজন্য গাছ কাটার লোক নেই। রসও এজন্য আগের মত হবে না। যে কেউ যেমন তেমন করে গাছ কাটলে তাতে রস হয় না। এখন দু’একজন নতুন গাছি আছে কিন্তু তারা এখন খিল মারতে পারে না। তো রস হবে কিভাবে। গাছ কাটা অনেক কঠিন কঠিন কাজ এতে রিক্সও আছে। এখন নতুন প্রজন্ম গাছিকে বেমানান মনে করে , এর চাইতে অনেক ভাল পেশা বা মজুরি খাটলে প্রতিদিন ৭ ০০ থেকে ৮০০ টাকা পায়। এজন্য এ পেশায় নতুন করে কেউ আসতে চাচ্ছে না। আমার দাদা গাছি ছিল আমার বাবাও ছিল সেখান থেকে আমি গাছি কিন্তু এখন আমার ছেলেরা কেউ এই পেশাকে বেচে নিচ্ছে না। বরং আমাকে এই পেশা ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু শীত শুরু হলেই খেজুর গাছ দেখলেই এই পেশাকে জাগরিত করে মনকে। আর এলাকার মানুষের কথা রাখতে এখনও গাছ কেটে যাচ্ছি। শ্রীরাম পুর গ্রামের গাছি নেসার আলী বলেন, মানুষ খেজুর রস খেতে চায় । বিশেষ করে এখনকার নতুন প্রজন্ম তো এই রস চেনেন না। তাই বাবা মার কাছে শুনে তারা গ্রামে আসে। কিন্তু সবাইকে রস দেয়া সম্ভা হয়না। কারন এলাকার বেশির ভাগ গাছ কাটা পড়ছে না গাছির অভাবে। আরেক গাছি আঃ সাত্তার জানান, এখন আমরা গাছ কাটি প্রথম চাচের জন্য গাছ প্রতি ৬০ টাকা। তারপর রস হলে মালিক অর্ধেক গাছি অর্ধেক। আগের মত এখন কেউ টাকা দিয়ে গাছে কাটে না। খেজুর রস খান প্রতি বছর মুক্তিযোদ্দা গোলাম মোস্তফা তিনি বলেন, খেজুর রস প্রত্যেক বছর গ্রামে এসে খাই আর স্ত্রী সন্তানদের জন্য ঢাকায় নিয়ে যাই। তবে স্বাদ আগের মত নেই। কারন হিসেবে তিনি বলেন, আগে গাছে রস ধরার জন্য মাটির ভাড় পুড়িয়ে রস ধরত কিন্তু এখন রস ধরে প্লাষ্টিকের পাত্রে । মাটির পাত্র না থাকায় রসের স্বাদও কমে গেছে। গত বছর তিনি রস কেনেন ভাড় ১২০ টাকা এবছর সেখানে ১৫০ টাকা করে। এক সময় রস কিনতে ৩০ টাকায়। তিনি মনে করেন , গাছির অভবে ধীরে ধীরে এটা হারিয়ে যাবে। এ ব্যাপরে উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি এক ধরনের শ্ল্ল্পি। এ জন্য দরকার হয় বিশেষ দক্ষতা। বর্তমানে যে হারে গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, তাতে এক সময় হয়তো এলাকায় খেজুর গাছ থাকবে না। এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাইলে আমাদের সবার উচিত বেশি করে খেজুর গাছ লাগানো। তাই তো তিনি কবির ভাষায় বলেন, মায়ের হাতের রসের পিঠা, মধুর মতো খেজুর মিঠা। তাই মনে পড়ে মায়ের কথা, মনে পড়ে মামা বাড়ি বেড়ানোর স্মৃতিকথা।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com