এফএনএস: লেখক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা তার শেখ মুজিবুর রহমান প্রবন্ধটা শেষ করেছেন এভাবে,‘আজ থেকে অনেক দিন পরে হয়তো কোনো পিতা তার শিশু পুত্রকে বলবেন জানো, খোকা! আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলো যার দৃঢ়তা ছিলো, তেজ ছিলো আর ছিলো অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিলো, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যো¯œারাতে রূপোলি কিরণ ধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি এবং নিশ্চয়তা বোঁধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তার ভালবাসা। জানো খোকা তার নাম? শেখ মুজিবুর রহমান’। এই শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি ছিলেন বাঙালির ইতিহাস। বাঙালির নেতা। ছিলেন বাঙালি জাতির পিতা। তাকে ছোট বেলা সবাই আদর করে ডাকত খোকা। তাঁর বাবার নাম ছিল শেখ লুৎফুর রহমান। বাবা গোপালগঞ্জের সিভিল কোর্টে রেকর্ড সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে খোকা ছিলেন তৃতীয়। গোপালগঞ্জ প্রাইমারি স্কুল এবং মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে লেখাপড়া করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে চোখের অপারেশনের জন্য তাকে স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। অপারেশনটি সেরে উঠতে অনেক সময় লাগে এবং চার বছর পর তিনি স্কুলে ফিরে আসেন।খোকারবয়স যখন ১৮ তখন শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই কন্যা -শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তিন ছেলে -শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। ১৯৪০ সালে শেখ মুজিব অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন এ যোগ দেন। তখন থেকেই তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সূচনা হয়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ) এ আইনের ওপর পড়াশোনা করেন এবং সেখানে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে শেখ মুজিব বেঙ্গল মুসলিম লীগএ যোগদান করেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অধীনে কাজ করতে থাকেন। দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তিনি ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ গঠন করেন। ক্রমে তিনি একজন শক্তিশালী ছাত্রনেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর ১৯৪৮ সালে দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে দ্বিমত। তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতো দিকপাল নেতাদের সঙ্গে মুসলিম লীগের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই সময় দিক-নির্দেশনা দেওয়া এবং নেতৃত্বহীন অসংগঠিত জনতাকে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগঠিত করার লক্ষ্যে মুসলিম লীগের বিকল্প একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার তাগিদ সৃষ্টি হয়। এই বাস্তবতা থেকেই আওয়ামী লীগের মতো একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন প্রগতিবাদি নেতাদের উদ্যোগে আহূত এক কর্মী সম্মেলনে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানায় ছিলেন। জেলে থেকেও নিজ যোগ্যতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বলে তিনি প্রথম যুগ্ম সম্পাদক মনোনীত হন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অদম্য শ্রম, নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও অসীম সাহসিকতার ফলে কোনো বিতর্ক ছাড়াই আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। শেখ মুজিব তখন জেলে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আপামর ছাত্রজনতা গড়ে তুলতে থাকে আন্দোলন। জেলে বসেও আন্দোলনকারীদের সমর্থন জুগিয়ে যান শেখ মুজিব। ১৩ দিন অনশন করেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। খাজা নাজিমউদ্দীন ও মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ এর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ এর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। মাচের্র ১১ তারিখে খালেক নেওয়াজ খান ও সামসুল হকের সাথে তিনি গ্রেফতার হন। ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাঁধ্য হয়। ১৯৪৯ সালে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ত্যাগ করে সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। এ আওয়ামী মুসলিম লীগ ই পরে আওয়ামী লীগ এ পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ের পরও যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভাকে ক্ষমতায় যেতে না দেয়ার প্রতিবাদ করায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রধান নেতায় পরিণত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঘোষণা দিলেন বাঙালির প্রাণের দাবি ছয় দফার। ছয় দফাকে বলা হয়-বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয় দফাকে পাক শাসকেরা চিহ্নিত করে রাষ্ট্রদোহিতা হিসেবে। শেখ মুজিব সহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ফলশ্র“তিতে জন্ম হয় ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুথানের। জনগণের দাবির মুখে সরকার এ মামলা তুলে নিতে বাঁধ্য হয়। জেল থেকে মুক্তির পর আপামর জনতার পক্ষ থেকে তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭০ সালে বিপুল ভোটে জয়ের পরও ইয়াহিয়া-ভুট্টো যখন ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি শুরু করে তখনই ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে দিলেন স্বাধীনতার ডাক, বললেন-আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন শাহ আলাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্র্মা, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” জেগে উঠল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়টা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী রাখা হলো। কিন্তু অবরুদ্ধ বাংলাদেশে এক মুজিব লক্ষ মুজিব হয়ে ছিনিয়ে আনলো স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাঁধ্য হয় পাক সরকার। দেশে ফিরে তিনি জানালেন-”আমার সেলের সামনে আমার জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছিল। আমি বলেছিলাম, তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙ্গালির কাছে দিয়ে দিও। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলব, আমার দেশ বাংলাদেশ, বাংলা আমার ভাষা”। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তখনও ভোর হয়নি। আকাশে হালকা একটা আলো। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বরবাড়িতে সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তখন বাড়িতে গার্ড পরিবর্তনের সময়। বাড়িতে ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান , তাঁর স্ত্রী বেগম মুজিব , ছেলে শেখ কামাল , শেখ জামাল , শেখ রাসেল , পুত্রবধুরা এবং ভাই শেখ নাসের। ডিউটিতে আছেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলাম, রাত ১ টার দিকে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। জাতির পিতা তখনও জানতেন না এটাই তাঁর পরিবারের সাথে তাঁর শেষ দেখা। শেষ রাত। সে রাতেই ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। বাঙালির কাছে কি বঙ্গবন্ধুর এই পাওনা ছিল ? যে বঙ্গবন্ধু না থাকলে স্বাধীনতা শুধু সোনার হরিণ হয়ে থাকত বাঙালির কাছে। সেই বঙ্গবন্ধুর জীবন দিতে হলো বাঙালির হাতেই। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি হয়েছে আমরা সবাই জানি। একবার কেন, ঐ খুনীদের লক্ষবার ফাঁসি হলেও বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা পূরণ হবার নয়।