এফএনএস এক্সক্লুসিভ: সম্পদের হিসাব না দিতে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি পাঁচ বছর পর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। কিন্তু সরকারের অনেক কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও সরকারি দপ্তরে কোনো তথ্য নেই। মূলত বৈধ আয়ের বাইরে বাড়তি আয় লুকিয়ে রাখতেই সম্পদের হিসাব দিতে অনীহা দেখাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। তাদের একাংশের মতে, কর্মচারীদের এই বিধিমালা সেকেলে এবং বর্তমানে তা প্রতিপালনযোগ্য নয়। কারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন আয়কর রিটার্ন জমা দেন এবং প্রত্যেকের ব্যক্তিগত টিন নম্বর রয়েছে। এ ছাড়া যারা বিধিমালা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত, তারাই সম্পদের হিসাব দেন না। বরং বিধিমালা সংশোধনীর নামে ১০ বছর সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। ৪৪ বছর আগে বিধিমালাটি করা হয়েছিল। এরপর ২০০২ ও ২০১১ সালে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় নির্দেশনাগুলো সংশোধন করা হয়নি। ফলে ২০১৪ সালে ফের সংশোধন কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তুজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১০ বছরেও চূড়ান্ত করতে পারেনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকার কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চেয়ে বহুবার চিঠি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও এ নিয়ে অনেকবার কথা বলেছেন। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ এতে পাত্তা দেননি। এ সুযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযুক্ত কর্মকর্তারাও পার পেয়ে যাচ্ছেন। সরকারি দপ্তরের পিয়ন থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতির বিষয়টি সবারই জানা। অনেক অফিস সহকারী, গাড়িচালেেকরও শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। বিগত ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেয়া হয়। কিন্তু ওই হিসাব বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে আছে। এরপর ২০১৫ সালে শুধু ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেয়া হলেও তা পর্যালোচনা করে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৯ সালে কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। সূত্র জানায়, সম্প্রতি উচ্চ আদালত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণী সংক্রান্ত বিধান যথাযথভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যমান বিধি বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানিয়ে তিন মাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জনস্বার্থে করা রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট রুলসহ এ আদেশ দেন। আদেশে আদালত বলে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশের আইন আছে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন নেই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ১৩(১) (২) বিধিমালা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ (স্থাবর-অস্থাবর) অর্জন ঠেকাতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্দেশিকা বা নীতিমালা করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের নিস্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না জানতে রুল জারি করেছে আদালত। সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ১৩(১) (২) বিধি অনুসারে অবিলম্বে যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (স্থাবর-অস্থাবর) সম্পদ বিবরণী দাখিল এবং তা আদালতে দাখিলের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তাও রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা জনগণের করের টাকা থেকে দেয়া হয়। তাদের বেতন-ভাতা বাবদ রাজস্বের ৪৩ শতাংশ খরচ করা হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ১৩(১) (২) বিধিমালা অনুসারে চাকরিতে যোগ দেয়ার এবং প্রতি পাঁচ বছর পর পর সম্পদ বিবরণী দেয়ার বিধান রয়েছে। দুর্নীতি ঠেকাতে এই বিধানের যথাযথ বাস্তবায়ন দরকার। তবে এই বিধিমালার ১০ বিধি অনুসারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধারদেনা বা আর্থিক প্রতিদান সম্পদ বিবরণীতে প্রকাশে ছাড় দেয়া হয়েছে। এমন আরো কিছু অস্পষ্ট ধারা ও বিধানের সুযোগ তাঁরা নিয়ে থাকেন। আর এ ধরনের অস্পষ্টতা-অস্বচ্ছতা দুর্নীতি সৃষ্টি করে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেরই বেতনের বাইরেও আয় আছে। ওই আয়ের হিসাব দেয়ার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, আয়কর রিটার্নে কর্মকর্তাদের পুরো সম্পদের হিসাব পাওয়া যায় না। আবার কেউ পুরো সম্পদের হিসাব জমা না দিলে ব্যবস্থা নেয়ারও কোনো সুযোগ থাকে না। সব দিক বিবেচনা করে কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করে বিধিমালা চূড়ান্ত করা হবে।