প্রফেসর মো. আবু নসর
বাংলা ভাষার গৌরবের মতোই বাংলার সাংস্কৃতিক অহংকার হলো বাংলা সন। তবে হিজরি থেকে উৎসারিত হয়েছে বাংলা সন। হযরত ওমর (আ:) ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। বছরটি ছিল ১৭ হিজরি। হিজরি সনের গণনা করা হয় চাঁদের হিসেবে আর বাংলা সন গণনা করা হয় সৌর হিসেবে। চন্দ্র বা চাঁদের হিসেবে ৩৫৪ দিন আর আর সৌর হিসেবে ৩৬৫ দিন। মুঘল সম্রাট আকবর পয়লা বৈশাখ প্রবতর্নের মাধ্যমে বাংলা সনের সূচনা করেন। ইংরেজি ১৫৮৪ সালে পয়লা বৈশাখকে বাংলা সনের প্রথম দিন নির্ধারণ করে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করা হলেও তার কার্যকারিতা দেখানো হয় ইংরেজি ১৫৫৬ সালের ১১মার্চ থেকে অর্থাৎ সম্রাটের সিংহাসন আরোহনের সময় থেকে। ৯৬৩ হিজরিতে ৩৫৪ দিনের গণনায় এনে সম্রাট আকবর নতুন বাংলা সন প্রবর্তন করেন। উল্লেখ্য, আকবরের রাজত্বকাল ছিল ১৫৫৬-১৬০৫ সাল পর্যন্ত। ইতিহাসের ভাষ্যমতে বাংলার স্বাধীন সুলতানী শাসন (১৩৩৮-১৫৩৮) পরবর্তীকালের পাঠান, আফগান ও ঈশা খাঁর নেতৃত্বাধীন বারোভূঁইয়া শাসনের অস্থির ধারাবাহিকতায় মোঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) বাংলার খাজনা আদায়ের বিষয়টিকে একটি বিশৃঙ্খল, জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে দেখতে পান। রাজনৈতিক সমস্যা ছাড়াও চান্দ্র মাস ভিত্তিক সাল গণনায় দেখা যায় যে, বছরের ১০-১১ দিন হ্রাস হয়ে মাসগুলো ক্রমান্বয়ে সারা বছরে আবর্তিত হতে থাকে। অথচ খাজনা দাতা কৃষিজীবীর জমির ফসল কিন্তু মৌসুম মতোই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়েই উৎপন্ন হয়। এতে খাজনা আদায়ের বার্ষিক সময়সূচী প্রতিবছরই পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ ধরে ‘ফসলী’ সন হিসেবে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের ঘটনা স্মরনীয় হয়ে আছে। সম্রাট আকবর বাংলা সহ বেশ কয়েকটি প্রদেশ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে কতিপয় ‘ফসলী সাল’ প্রবর্তন করেন। বাংলা বর্ষ সম্রাট আকবর প্রবর্তিত সেই সব ফসলী সালের একটি। সেই সময় থেকে এ দেশের মানুষ চাষাবাদ, খাজনা পরিশোধ, সংবছরের হিসাব-নিকাশ সব কিছুতেই বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে থাকে, যেটা মুঘল শাসন আমল বাবর থেকে শুরু করে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত বিস্তৃত। তারপর পট-পরিবর্তনের পালায় বৃটিশ আমল ও পাকিস্তান আমল পার হয়ে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে বাংলা সন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালেই বাংলা সনের প্রবর্তন ও প্রচলন। তিনি দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ১৫৫৬ খ্রিষ্ঠাব্দে। ২৯ বছর রাজত্ব করার পর তিনি পঞ্জিকা ও বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। হিজরি সন ও সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছরকে সংযুক্ত করেই বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। সন আরবি শব্দ। অর্থ হলো অব্দ বা বর্ষ বা বর্ষপুঞ্জ। আবার সনকে সাল বলা হয়। সাল ফার্সি শব্দ। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ৯৬৩ হিজরিতে ৩৫৩ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিন গণনায় এনে নতুন একটি সন প্রবর্তন করা হয়, এটাই বাংলা সন। হিজরি সন হলো চান্দ্র সন। চাঁদ দেখে গণনার উপর এ সনের ভিত্তি। বাংলা সৌর সন। সৌর সনে দিনক্ষন গণনা করা সহজ এবং এর একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি আছে। সম্রাট আকবরের অর্থ বিভাগের উপদেষ্টা টোডরমলের সহকারী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নাম থেকে নিয়ে সৌর মাসের দিন মিলিয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের দরবারে বিখ্যাত ‘নবরত্ন সভার’ বাইরেও অনেক মেধাবী পন্ডিত ছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজী। তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন বর্ষ প্রণয়নের। বাংলা সনের ইতিহাস ঘটনা বহুল। চন্দ্র মাসের হেরফেরের কারণে ফসল কাটায় বিলম্ব ঘটতো আর সেই বিলম্ব থেকে খাজনা আদায়ের সমস্যা হতো। সেই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। বাংলা সনের গণনা শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই। জানার বিষয় হলো রাসুল (সাঃ) এর হিজরতের সময় থেকেই বাংলা সনের গণনা ধরা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়- বাঙালিদের বঙ্গ অঞ্চলের সরকারি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই মোঘল সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করা হয়। তবে বাংলা সনের গণনা সম্রাট আকবরের দিল্লীর সিংহাসন আরোহন করার দিন থেকে শুরু হলেও এটা সত্য যে, হিজরি সনই হলো বঙ্গাব্দের মূলভিত্তি। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) এর সময়কালে হযরত আলী (রা.) এর প্রস্তাবে মহানবী (সাঃ) এর হিজরতের দিন থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। সেটা ছিল ৬২২ খৃষ্টাব্দের ১৬ জুলাই। খৃষ্টাব্দ সন যেমন এসেছে হযরত ঈসা (আঃ) তথা যিশু খৃষ্ট্রের জন্মের পর থেকে, তেমনি হিজরি সন গণনা শুরু হয়েছে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মের পর থেকে আর হিজরি সন থেকেই সূচনা হয় বাংলা সন। এর আগে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সনের মহরম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। বাংলা সনের ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে হবে। বাংলা সাল নিজস্ব সাল। আর প্রতিমাসের নাম যেন নিজস্ব নাম। বাংলা নববর্ষের প্রথম পহেলা বৈশাখ শুধু একটি তারিখ নয়। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির বিশাল উপলক্ষ্য, যা অত্যন্ত গর্বের। প্রাণের এই সাংষ্কৃতিক উৎসবে মিশে আছে বাংলার মানুষের হাজারো ইতিহাস, ঐহিত্য ও সংষ্কৃতি। বৈশাখ আমাদের সম্প্রীতির বন্ধন। বৈশাখ থেকে আমরা শিখতে পারি একটি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা। বাঙ্গাব্দ/নববর্ষ এখন জাতীয় উৎসব ও বাঙালির সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। নববর্ষ উদযাপনের রীতিও অনেক প্রাচীন। সেকালের প্রাচীন মানুষ নববর্ষে দিন-ক্ষন-লগ্নি ঠিক করতো সূর্যের উত্তরায়নে ও দক্ষিণায়নে ঋতু পরিবর্তন দেখে। তাই বলা হয় নববর্ষ ঋতুভিত্তিক বা আর্তব উৎসব। বাংলা ভাষার মতো বাংলা বর্ষগণনা পদ্ধতি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর যে নতুন সনের প্রবর্তন করেন তার পূর্বে এ অঞ্চলে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ভাবে বর্ষ গণনার প্রচলন ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- মল্লাব্দ, শকাব্দ, বিক্রমাব্দ, হর্ষব্দ, বুদ্ধাব্দ, পালাব্দ, চৈতন্যাব্দ, গুপ্তাব্দ, নশরত শাহী সন, শালিবাহন সন, জালালী সন, সেকান্দর সন, ভাতর সন ইত্যাদি। তখনকার প্রচলিত সনগুলোর অধিকাংশই গণনা করা হতো চান্দ্র মাসের হিসেব অনুযায়ী। সময়ের গতিময় নিজস্বতা ভুলে আমরা যতই বিশ^জনীন হয়ে উঠি না কেন, আমাদের অস্তিত্বে প্রেরণা জুড়ে বৈশাখের প্রথম দিনটিই যেন ছড়িয়ে দেয় লাল আভা। নববর্ষের পয়লা বৈশাখ বাঙালির আকাশে এক নতুন সূর্যোদয়। বাঙালি জাতির জীবনে এক মহা আনন্দের দিন। পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয় আরেকটি নতুন বছরের শুভ সুচনা, নতুনভাবে পথচলা, নতুনের আবাহন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও অপরিহার্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধে উজ্জ্বীবিত এ মিলনমেলা। বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ। সর্বজনীনতার ক্ষেত্রে এর কোনো তুলনা নেই। যেটা আমাদের ঐক্যসূত্রে গাঁথার এক মূলমন্ত্র। বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় সত্ত্বার প্রতীক ও ইতিহাস ঐতিহ্য মন্ডিত। বাঙালির সংস্কৃতির স্বতন্ত্র বিকাশে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো বালা নববর্ষ। পয়লা বৈশাখ বাঙালির ইতিহাস ও চিরায়ত ঐতিহ্য, প্রত্যাশার একটি রেখাচিত্র। ১৪৩০ নববর্ষে সবার জীবন আনন্দময় হয়ে উঠুক সেই প্রত্যাশা সকলের। বাংলা নর্ববষের প্রথম দিনটি বাঙালির জীবনে একটি প্রধান উৎসবের দিন হিসেবেই পালিত হয়ে থাকে। প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠির নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান থাকলেও একমাত্র পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠানটি-ই বাঙালির অসাম্প্রদায়িক একটি আনন্দ অনুষ্ঠান, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ পালন করে থাকে। আর তাই পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে প্রাণের উৎসব। বর্ষ পরিক্রমায় পুরাতন বছর বিদায় নেয় তার গ্লানি আর জীর্ণতা নিয়ে, আগমন ঘটে সম্ভবনাময় নতুন বছরের। নববর্ষের হৈমান্তিক সোনাঝরা সুপ্রভাত আসছে বাংলা আরো একটি নতুন বছর ১৪৩১ সন।
লেখক:
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা।
মোবা: ০১৭১৭-০৮৪৭৯৩