এফএনএস এক্সক্লুসিভ: সরকারি ব্যাংকগুলোতে জনবল কাঠামো ভঙ্গ করে নজিরবিহীন পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেই এই গণপদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে। পদ না থাকলেও সরকারি চার ব্যাংকে ৭ হাজার ২১৫ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। আর বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছে। এর মধ্যে সুপার নিউমারারি (পদ ছাড়াই পদায়ন) ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়েছে ৭ হাজার ২১৫ জন। নজিরবিহীনভাবে পদ না থাকলেও এতো বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। ফলে ওসব ব্যাংকে এখন শৃঙ্খলা আরো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারি ব্যাংকে উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম), সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও), প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) ও সিনিয়র অফিসার (এসও) পদে সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৭ জনকে এসপিও থেকে এজিএম বানানো হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহী পদের প্রথম ধাপ হলো এজিএম। বেতন—ভাতা ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি এজিএম হওয়া প্রত্যেক কর্মকর্তা ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা ঋণ পায়। আর ক্রয়কৃত গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে পান ৪২ হাজার টাকা। তাছাড়া এজিএমদের জন্য ব্যক্তিগত কক্ষও বরাদ্দ থাকে। কিন্তু বর্তমানে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কক্ষ ও চেয়ার—টেবিল দিতেই হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। সূত্র জানায়, সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক তথা ৫০ শতাংশই এখন খেলাপি। মূলধন ও সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। কেবল সরকারি ব্যাংক পরিচয়ে অস্তিত্ব টিকে আছে। ওসব ব্যাংকের খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর রেকর্ডসংখ্যক পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পেছনে ওই ব্যাংকগুলোর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে। সরকারি সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালীতে প্রথম গণপদোন্নতির ঘটনাটি ঘটে। চাপের মুখে গত ২৩ ডিসেম্বর ওই ব্যাংকে ২ হাজার ১৯২ জন কর্মকর্তাকে সুপার নিউমারারির ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর মধ্যে কেবল সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও) থেকে সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) পদেই পদোন্নতি পান ৪৩৩ জন। পরের দিন পদোন্নতির দাবিতে অগ্রণী ব্যাংক কর্মকর্তারা পরিচালকদের ঘেরাও করে রাখে। প্রথমে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের দাবির মুখে অগ্রণী ব্যাংক পর্ষদরেকর্ড ৩ হাজার ৭৭ জন কর্মকর্তাকে সুপার নিউমারারি বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়। এর মধ্যে ২১৬ জন কর্মকর্তাকে এসপিও থেকে এজিএম পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) থেকে এসপিও করা হয় ৫৮৫ জনকে। আর সিনিয়র অফিসার (এসও) থেকে ৮২৯ জন প্রিন্সিপাল অফিসার পদে পদোন্নতি পান। তাছাড়া আরো ১ হাজার ৪৪৭ জনকে সিনিয়র অফিসার পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। আর সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের পর গণপদোন্নতি দিয়েছে রূপালী ও জনতা ব্যাংক। এর মধ্যে রূপালী ব্যাংক ১ হাজার ৩৬৮ জনকে সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দিয়েছে। এর মধ্যে পদ না থাকা সত্ত্বেও রেকর্ড ৮১ জনকে এজিএম থেকে ডিজিএম পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। আর ৩৮৫ জনকে এজিএম করা হয়েছে। আর ৪১৯ জন এসপিও এবং ৪৮৩ জন পিও হয়েছে। আর জনতা ব্যাংক ৫৭৮ জনকে সুপার নিউমারারি পদোন্নতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে সুপার নিউমারারি ও যোগ্যতার ভিত্তিতে িও চার ব্যাংকে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি না পাওয়া সব কর্মকর্তাই নিজেকে বৈষম্যের শিকার বলে দাবি তুলেছে। বর্তমান সরকারের নিয়োগ দেয়া চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা কতৃর্পক্ষকে এক প্রকার জিম্মি করে কর্মকর্তারা গণপদোন্নতি নিয়েছে। যদিও সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই গত ১৫ বছর নানা ধরনের অনিয়ম—দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। কেউ কেউ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের লুণ্ঠনের সহযোগীও ছিলেন। চেয়ারম্যান, পরিচালক ও শীর্ষ নির্বাহীর আশীর্বাদ পেতে ব্যাংকিংয়ের রীতিনীতি না মেনেই তারা বেনামি ঋণের নথিপত্র তৈরি করেছেন। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের মোট জনবল ছিল ২ লাখ ৮ হাজার। এর মধ্যে সরকারি ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকেই ৪৯ হাজার ১৮৩ জন কর্মরত ছিলেন। আর সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত তিন ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন ১৩ হাজার ২০৪ জন। তাছাড়া বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলোয় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭৯ জন কর্মরত রয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক তথা সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের প্রতি চারজনের একজন গত ২০ দিনে পদোন্নতি পেয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকে গণপদোন্নতির ধাক্কা অন্য ব্যাংকগুলোয়ও লেগেছে। বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এখন সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতির দাবি তুলেছে। দাবি আদায়ে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা পরিচালনা পর্ষদকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। যদিও ২০০৯ সালের পরের তিন বছরে লুণ্ঠনের শিকার হওয়া ব্যাংকটি এখনো হাবুডুবু খাচ্ছে। গত ১১ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ওই ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে ব্যাংকটিকে বাঁচানোর জন্য সরকার বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে। বিপুল অংকের এ অর্থ পেয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেসিক ব্যাংক। উল্টো ব্যাংকটি এখনো প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬৫ শতাংশ এখন খেলাপি, যার পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয়ও গণপদোন্নতির দাবি উঠছে। সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দিতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা সভা—সমাবেশ করছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কেবল কৃষি ব্যাংকে ১ হাজার ৪০০ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছে। এর পরও সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দিতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কতৃর্পক্ষের ওপর চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকে গণপদোন্নতির বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী জানান, সরকারি ব্যাংকগুলোয় এখন যেসব কর্মকর্তা কাজ করছে তারা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির নেয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পেয়েছে। কিছু কর্মকর্তা যোগ্যতা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী কোনো পদে ৩০টি আসন ফাঁকা থাকে, সেখানে ৮০০ কর্মকর্তা প্রতিযোগিতা করছে। এভাবে অনেক মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তা পদোন্নতির বাইরে থেকে যাচ্ছিলো। এ কারণে সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই ৬—৯ বছর একই পদে আটকে ছিলেন। আর দীর্ঘদিন একই পদে আটকে থাকলে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা চলে আসে। কাজ করতে নিরুৎসাহিত হন। আশা করা যায় পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা নিজেদের তৎপরতা বাড়াবেন। ব্যাংকের উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন।