এফএনএস: চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বেসরকারি একটি কন্টেইনার ডিপোতে আগুনের পর ভয়াবহ বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ জন হয়েছে; দগ্ধ ও আহত শতাধিক ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস চৌধুরী। চট্টগ্রাম নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কদমরসুল এলাকায় বিএম ডিপো নামের ওই কন্টেইনার টার্মিনালে গত শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন লাগে। পরে রাসায়নিকের কন্টেইনারে একের পর এক বিকট বিস্ফোরণ ঘটতে থাকলে বহু দূর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সবগুলো ইউনিট চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় রাতে সাড়ে ৩টার দিকে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিলা থেকে অগ্নি নির্বাপক গাড়ি পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি দল। চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান গতকাল রোববার সকালে জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও বারবার বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ডিপোতে রাসায়নিক থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে। রাসায়নিকের কারণে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অনেকে। নিহতদের মধ্যে ১৫ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন, মোমিনুল হক, মহিউদ্দিন, হাবিবুর রহমান, রবিউল আলম, তোফায়েল ইসলাম, ফারুক জমাদ্দার, আফজাল হোসেন, মো. সুমন, মো. ইব্রাহিম, হারুন উর রশিদ, মো. নয়ন, শাহাদাত হোসেন, শাকিল তরফদার, শাহাদাত উলাহ জমাদার ও ফায়ার সার্ভিস কর্মী মনিরুজ্জামান। খবর পেয়ে আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিটের সদস্যরা পরবর্তী সময়ে অন্য কনটেইনারের বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত নয় জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপ-সহকারী পরিচালক শাহজাহান। র্যাব-৭ এর প্রধান মো. ইউসুফ বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি ডিপোর ভিতর যারা আটকে পড়েছিল তাদের বের করতে। অনেক মানুষকে আমরা সবাই মিলে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। আহত ও দগ্ধদের মধ্যে অন্তত ১১ জন পুলিশও রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুই পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে থাকা আমাদের প্রতিবেদক জানান, সীতাকুন্ডে উদ্ধার তৎপরতা শুরুর পর রাত ১২টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের হাসপাতালে আনা শুরু হয়। একপর্যায়ে রোগীর চাপ বেড়ে গেলে এন্ট্রি করার চেষ্টা বাদ দেওয়া হয়। মেডিকেলের পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন বেরসকারি হাসপাতালেও রোগীদের নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াস রাতেই আহতদের সেবায় নগরীর চিকিৎসকদের এগিয়ে আসার আহŸান জানান। সকালে ডিপোতে এসে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো আশরাফ উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা এবং প্রাথমিকভাবে আহতদের ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সব বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্রুত তদন্ত কমিটি করা হবে। এখনো পর্যন্ত মালিকপক্ষের কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি। সেনাবাহিনীর দল এসেছে। গতরাতে আগুন লাগে, আপনারা দেখছেন, এখনো জ¦লছে। ডিপোতে ড্রেন আছে, সেই ড্রেন হয়ে খালে গেছে সেই খাল আবার সাগরের সাথে সংযোগ আছে। রাসায়নিক যাতে সাগরে না যায় সে লক্ষ্যে ওঁরা কাজ করছেন। সেনাবাহিনীর ১ ইঞ্জিনিয়ার কোরের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিরা সুলতানা বলেন, সমুদ্রে যাতে রাসায়নিক না যায়, সেটা প্রটেক্ট করাই এখন আমাদের মূল কাজ। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। কিন্তু কয়টা কন্টেইনারে রাসায়নিক ছিল তা এখনো জানা যায়নি। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাজাহান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের বলেন, এই ডিপো যারা পরিচালনা করছেন, তাদের আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। তারা ফায়ার ব্রিগেডকে গাইড করতে পারবে কোথায় কোন কন্টেইনার আছে। তাহলেই আগুন নেভানো সম্ভব। তাদের আহŸান করছি তারা যেন দ্রুত এখানে আসে। এখানে সব রপ্তানি পণ্য আসে। রপ্তানির মধ্যে রাসায়নিক থাকতে পারে। ফায়ার ব্রিগেড জানিয়েছে রাসায়নিকের ২৬টি কন্টেইনার ছিল। ভিতরে গিয়ে দেখলাম ইকুইপমেন্ট আছে, কিন্তু লোকজন নেই ডিপোর। এমনকি ট্রেইলারও সেখানে রয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাঈনুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, কুমিলা ও ফেনীর ২৫টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করছে। সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানিও অগ্নি নির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছেন। এখানে কয়েকটা ড্রামে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড লেখা পেয়েছি। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল এসেছেন। মালিকপক্ষের কাউকে আমরা পাইনি। কোথায় কোন পণ্যের কন্টেইনার রেখেছেন তা তো আমরা জানি না। বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন বিএম ডিপোর জেনারেল ম্যানেজার (সেলস ও মার্কেটিং) নাজমুল আকতার খান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২৪ একর জমিতে এই ডিপো। প্রায় ৪৩০০ কন্টেইনার ছিল। ৩০০০ হাজার খালি। ৪৫০ কন্টেইনারে আমদানি আর ৮০০ এর মত রপ্তানি কন্টেইনার। রাসায়নিক পণ্যের কন্টেইনার আলাদা রাখা হয়। কত রাসায়নিক কন্টেইনার ছিল তা জানা নেই। আগুন কীভাবে লাগল প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তদন্তের পর বোঝা যাবে, কেন আগুন লাগল। স্যাবোটাজও হতে পারে। কী হয়েছে কেবল তদন্ত বলতে পারবে। সরকারের কাছে আহŸান, পুরো তদন্ত হোক। মূলত পোশাক ও খাদ্য পণ্য রপ্তানির জন্য ছিল। পোশাকের কন্টেইনারে আগুন লাগলেও তা ছড়িয়ে যেতে পারে। তার সঙ্গে থাকা ডিপোর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল আলম খান স্বপন বলেন, হাজার কোটি টাকার পণ্য আছে এই ডিপোতে। শত শত কন্টেইনার পুড়েছে। রাতে সব রকমের কর্মীরা কাজ করছিল। দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি। কারণ এখানে বেশিরভাগ রপ্তানি পণ্য। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাত ৮টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি।