স্টাফ রিপোর্টার \ প্রকৃতি যেমন অপরূপ সাজে সজ্জিত তেমনি প্রাণীকুল দিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল উজ্জীবিত। দুর্গম গিরি, শুকনো ধূসর মরু, তরুলতায় বিস্তৃত সবুজ পল্লী, কখনো বা সুবিস্তৃত দৃষ্টিসীমা জুড়ে বিশাল অরণ্যের মাঝে প্রাণীকুলের হৃদয়অঙ্গম দৃশ্যে কখনো বা খুনসুটি দৃশ্যে মর্ত্য। মায়াবী, নিরীহ, হিংস্র সব ধরনের প্রাণীকুলের পদচরণায় মুখরিত বিশেষ বিশেষ কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক বৃহত্তম বনগুলো। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ লোনাপানির বন সুন্দরবন। এই বনের প্রধান আকর্ষণ ও নিরীহ প্রাণীর মধ্য মায়াবী চিত্রালী হরিণ অন্যতম। বনের অভয়ারণ্য চিত্রালী হরিণের অবাধ পদচারণে মুখরিত। মাঝে মাঝে খাদ্যের সন্ধানে শুকনো মৌসুমে বনের কিনারে নদীর তীরে এদের দেখতে পাওয়া যায়। হরিণ আর বানরের খুনসুটি দৃশ্য মজার ব্যাপার। বানরের গাছ থেকে পাতা ফেলে দেবে আর হরিণ সেটা খাবে। কখনো বা হরিণের পিঠে চড়ে বানর বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে চলবে। অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির মাঝে প্রাণীর এই মিলন মেলা যেকোনো মানব মনকে নিয়ে যায় কল্পনা রাজ্যের গহীন থেকে গহীনে। এমন দৃশ্য পর্যটকদের মনে আবেগঘন মুহূর্ত সৃষ্টি করে। অথচ এই নিরীহ প্রাণী শিকার যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। বর্তমানে হরিণ শিকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হরিণ ধ্বংসযজ্ঞের অসৎ পিপাসায় লিপ্ত এসব হরিণ খেকোরা। সুন্দরবন সংলগ্ন বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর এক শ্রেণীর অসাধু জনগণ এই অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাওয়ালি, মৌয়ালি সহ পর্যটকদের মধ্য কিছু অসাধ লোকজন এই হরিণ শিকারের সাথে জড়িত। গরু, ছাগলের মাংসের চেয়ে সহজ মূল্যে হরিণের মাংস বিক্রি হয় সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলে। সহজ মূল্য ও হরিণের মাংসের প্রতি অতৃপ্ত বাসনা থেকে হরিণের মাংস কেনার প্রতি ঝোক প্রায় সব শ্রেণী মানুষের। আর এই সুযোগ গ্রহণ করছে হরিণ শিকার চক্রটি। অনেক সময় সুন্দরবন সংলগ্ন এসব গ্রামের বাইরে শহরেও পাচার হচ্ছে হরিণের মাংস। প্রশাসনের গতানুগতিক দায়সারা দায়িত্ব পালন। মাঝে মাঝে জীবিত হরিণ, জবাই করা হরিণ, হরিণের কাঁচা মাংস, রান্না করা মাংস সহ হরিণ শিকারের ফাদ জব্দ করে বনবিভাগ। মূল চোর ও চোরাকারবারিরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দু একজন ধরা পড়লেও তারা আইনের ফাক ফোকড় দিয়ে বাহির হয়ে যায়। সুন্দরবনের হরিণ ধরার জন্য বনের গহীন থেকে গহীনে হরিণের অভয়ারণ্য অঞ্চলে শিকারীদের পৌঁছে বিভিন্ন কলা কৌশলে হরিণ শিকার করতে হয়। অথবা হরিণ সচরাচর চলাচলের পথে বিভিন্ন কৌশল, সিটা কল পেতে, নাইলনের জাল পেতে, স্পি্রং বসানো ফাঁদ পেতে, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনা নাশক ওষুধ দিয়ে, তীর অথবা গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়। হরিণ শিকার বিষয়টি একবারে অতি সহজলভ্য নয়। শুধু অপতৎপরতাকারী চোরা শিকারিরা নয় হরিণ নিধনের সাথে অনেক অসাধু বন বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও জড়িত। চোরা কারবারীরা এত প্লান পরিকল্পনা সুকৌশল অবলম্বন করতে পারলে, এসব গুপ্তচরদের ধরতে সংশ্লিষ্ট বনবিভাগ অতি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। অসৎ লোক যতই শক্তিশালী হোক প্রশাসনের চেয়ে শক্তিশালী নয়। সুন্দরবনের বনদস্যু নির্মূল করা সম্ভব হলে। হরিণ শিকার নির্মূল করা সম্ভব নয় কেন? এমন প্রশ্ন জনমনে। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের তিনটি শ্রেণীর মধ্যে হরিণ প্রথম শ্রেণীর খাদক। এক স্তরের প্রাণী তার নিচু স্তরের প্রাণীর উপর নির্ভরশীল। এজন্য কোন শ্রেণীর খাদক বিলুপ্তি হলে বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীর খুঁটিনাটি সবকিছু একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি অপরটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিষয়টি অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের দায়সারা দায়িত্ববোধ থেকে বাহির হয়ে আন্তরিক হতে হবে সুন্দরবনের প্রতি। মমত্ববোধের অন্তর্নিহিত চোখে তুখোড় দৃষ্টি রাখতে হবে বাংলাদেশের গর্ব প্রিয় সুন্দরবনের দিকে। অপরাধীদেরকে কঠোর থেকে কঠোর আইনি শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সুন্দরবন সংলগ্ন বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে হরিণ নিধনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সকল শ্রেণীর পেশা মানুষের মধ্য গনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলেই হরিণ শিকারিদের অশুভ দৌরাত্ব বন্ধ করা সম্ভব। হরিণ শিকার জিরো টলারেন্সে নিয়ে আসতে পারলে প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম সুন্দর বনে হরিণের সংখ্যা বহু গুনে বেড়ে যাবে। মুক্তবিহঙ্গের কলকাকলী, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবাধ বিচরণ, পাখির গান, নদীর তান আর প্রকৃতির সবুজ শ্যামল বৃক্ষরাজি উদ্ভিদের অপরূপ সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি নৈসর্গিক ভূস্বর্গে পরিণত হবে। প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবন সুন্দর থাকলে সুন্দরবনের ইকো ব্যালেন্স ব্যালেন্সই থাকবে অর্থাৎ ভারসাম্যপূর্ণ থাকবে বাস্তুসংস্থান। সুন্দরবন সুন্দর রাখার জন্য আমরা কিছু নাইবা করি শুধুমাত্র আমরা নিজেরা সুন্দরবনকে অনিষ্ট বা ক্ষতি না করি। তাহলে আমাদের মাতৃভূমির গর্বের প্রতীক প্রিয় সুন্দরবন সুন্দর থাকবে মহান স্রষ্টার অসম শক্তির বলয়ে। মহান স্রষ্টা প্রদত্ত প্রকৃতির এক সুন্দর উপহার পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভবন সুন্দরবন জাতীয় রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। তাই জাতীয় স্বার্থে সুন্দরবন সংলগ্ন বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা ও একীভূতচেষ্টায় সুন্দরবনকে সুন্দর রাখার দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ করতে হবে।