এফএনএস : পর্যটন মৌসুমে সুন্দরবনে জেঁকে বসেছে বনদস্যুরা। আতঙ্কে জেলে, বাওয়ালি ও পর্যটকরা। বন কর্মকর্তারা দস্যুদের তৎপরতা বন্ধে পুলিশ, কোস্টগার্ড ও র্যাবের যৌথ অভিযানের পরিকল্পনার কথা জানালেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটছে না। বরং গত দুই মাসে খুলনার কয়রা, দাকোপ, সাতক্ষীরা কৈখালী ও শ্যামনগরে কমপক্ষে ২০ জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপরহণের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বনদস্যুরা বনের কয়েকটি স্থানে নৌকাপ্রতি টোকেন ফি আদায় করছে। টাকা না দিলে মুক্তিপণ চেয়ে জেলেদের অপহরণ করা হচ্ছে। টোকেন ছাড়া মাছ ও কাঁকড়া আহরণ সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া সুন্দরবনের মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে বনদস্যুর পরিচয়ে চাঁদা চেয়ে প্রায়ই হুমকি দেয়া হচ্ছে। বন বিভাগ এবং ভুক্তভোগীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনে টানা ৯ মাস পর্যটন মৌসুম। তবে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন ও পর্যটন কেন্দ্র, হারবাড়িয়া, শরণখোলাসহ লোকালয়ের কাছে বনে সারা বছরই পর্যটনের সুযোগ থাকে। প্রতি বছর গড়ে প্রায় দুই লাখ দেশি—বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করলেও দস্যুতার কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ইকোট্যুরিজম। সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি ও নদী—খাল থেকে মাছ—কাঁকড়া আহরণের জেলে, ছন—গোলাপাতা ও মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালসহ বনজীবীরা এখন বনদস্যুদের মুক্তিপণ আদায়ের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। আর বনদস্যুরা বাঘ—হরিণসহ বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারে নেমে পড়লে হুমকির মুখে পড়বে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। সুন্দরবনে দস্যুতা শুরুর বিষয়টি বন বিভাগকে ভাবিয়ে তুলেছে। দমন করতে বনরক্ষীদের পাশাপাশি বন বিভাগ পুলিশ, কোস্টগার্ড ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ শুরু করেছে। ২০১৬—২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলো। আর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়েছিলো। সূত্র জানায়, বিগত ১৫ ডিসেম্বর দস্যুরা সুন্দরবনে পুষ্পকাটি মেটে খাল থেকে কাঁকড়া ধরার সময় মুক্তিপণের দাবিতে দুই জেলেকে অপহরণ করে। শারীরিক নির্যাতনের পর ১ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। ১৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা রেঞ্জে তিন জেলে ও ৮ নভেম্বর মালঞ্চ নদে খুলনার কয়রার দুই জেলেকে অপহরণ করে দস্যুরা। তাছাড়া বিগত ১৬ সেপ্টেম্বর কালাবগি এলাকায় অহিদুল শেখ নামে এক জেলে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। তাকে দস্যু বাহিনী সুন্দরবনের শরবতখালী খাল থেকে অপহরণের পর মারপিট করে রক্তাক্ত অবস্থায় ট্রলারে বেঁধে রাখে। সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৬ জেলে অপহরণের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ জেলেকে উদ্ধার করে বনবিভাগ। বাকিরা মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। তবে বেসরকারিভাবে এর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। নানা কারণে সব ঘটনা বন বিভাগের কাছে আসছে না। নতুন নতুন ডাকাত দলকে বনের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখার কথা জানিয়েছেন পর্যটক ও স্থানীয় বনজীবীরা। আর মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেরা জানায়, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত পশ্চিম সুন্দরবনে বনদস্যুদের নতুন কয়েকটি দল তৎপরতা শুরু করেছে। দস্যুদের তাণ্ডবে ভুক্তভোগী জেলে—বাওয়ালিরা সরাসরি কেউ অভিযোগ করতে আগ্রহী নয়। তবে বন বিভাগের পক্ষ থেকে টহল ফাঁড়িকে সতর্ক থাকার দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ১২ নভেম্বর দাকোপের ঠাকুরবাড়ি ঘাট থেকে দুটি একনলা বন্দুক ও চার রাউন্ড কার্তুজসহ দুই বনদস্যুকে গ্রেপ্তার করে কোস্টগার্ড। এদিকে এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা রেঞ্জে সহকারী বন সংরক্ষক মো. মশিউর রহমান জানান, বনবিভাগের পক্ষ থেকে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। পুলিশ, কোস্টগার্ড ও র্যাবের যৌথ অভিযানের চিন্তা—ভাবনা চলছে। তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।