মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৫ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

স্বপ্ন পূরণের ঠিকানায় শাহাদাত

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৬ জুন, ২০২৩

এফএনএস স্পোর্টস: শুরুতেই লেগ স্পিনারকে দারুণ এক স্কয়ার কাট। পরে পেসারদের বিপক্ষেও বেশ স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল ব্যাটিং। কে বলবে, জাতীয় দলের হয়ে শাহাদাত হোসেনের প্রথম নেট সেশন এটি! কোনো জড়তা কিংবা অস্বস্তি দেখা গেল না বাংলাদেশ টেস্ট স্কোয়াডের এই নবীনের ব্যাটিংয়ে। তবে তার এই পর্যন্ত আসার পথচলাটা এত মসৃণ নয়, তার জীবনের গল্পটা এত সহজ নয়। কঠিন বাস্তবতার পথ পাড়ি দিয়ে স্বপ্ন পূরণের পথে এতটা দূর এসেছেন ২১ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সোমবার সকালে গা গরমের দৌড় ও ফিল্ডিং সেশন শেষে ক্রিকেটারদের গন্তব্য ছিল ইনডোরের বাইরের নেট। পাশাপাশি নেটে ব্যাটিং শুরু করেন মুশফিকুর রহিম ও নাজমুল হোসেন শান্ত। তবে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা তখন বারবার খুঁজছিল শাহাদাতকে। তখনও তিনি ব্যাটিংয়ে নামার অপেক্ষায়। পরে নেটে গিয়ে কাটালেন তিনি আনন্দময় সময়। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে ঘরোয়া ক্রিকেট ও ‘এ’ দল হয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টের বাংলাদেশ স্কোয়াডে ঠাঁই মিলেছে তার। যে দিনটির দেখা পেতে তাকে লড়াই করতে হয়েছে অজ¯্র দিন-রাত্রি। মাঠের বাইরের কঠিন জীবন সংগ্রামে তার মাঠের জীবনকে করে তুলেছিল অনিশ্চিত। ¯্রফে ৮ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবা হারান তিনি। চট্টগ্রামে তখন থেকেই দুই ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় তার মায়ের জীবন সংগ্রাম। পরিবারের খরচ মেটাতে বাবার মতোই গাড়ি চালানোর কাজ শুরু করেন বড় ভাই আবুল হোসেন। শাহাদাত হাঁটেন ক্রিকেটের পথে। তবে ব্যয়বহুল এই খেলা চালিয়ে নেওয়ার তেমন সামর্থ্য ছিল না তাদের। আর্থিক অনটনে খেলা ছেড়ে দেওয়ার ভাবনাও খেলা করছিল কিশোর শাহাদাতের মাথায়। তখন তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভাব ঘটে সুদীপ্ত দেব নামে এলাকার এক বড় ভাইয়ের। এলাকার খেলায় ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হওয়া ওই বড় ভাই-ই পরে সব ধরনের সহযোগিতা করেন শাহাদাতের এগিয়ে যাওয়ার পথে। সুদীপ্তর হাত ধরে ইস্পাহানি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হন শাহাদাত। সেখান থেকেই শুরু হয় তার নতুন অধ্যায়। পরে অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ পেরিয়ে তিনি জায়গা করে নেন ২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্যের ওই আসরে ৪ ইনিংসে ১৩১ গড়ে ১৩১ রান করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেন ৭৪ রানের অপরাজিত ইনিংস। এরপর নানা পথ পেরিয়ে এখন তিনি সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার অপেক্ষায়। জাতীয় দলে প্রথম দিনের অনুশীলনের পর রোমাঞ্চিত শাহাদাত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথোপকথনে ফিরে তাকালেন পেছনে, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেন তার বড় ভাই ও সুদীপ্ত দেবের অবদান। “আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি। আস্তে আস্তে যখন বড় হই, তখন আমার বড় ভাই অনেক সাহায্য করেছেন। সুদীপ্ত ভাই ছিলেন। উনি ক্রিকেটে অনেক সাহায্য করেছেন। (ক্রিকেটের) জিনিসপত্র থেকে শুরু করে সবকিছু দিয়েই। ওভাবেই আস্তে-ধীরে এগোনো।” যুব বিশ্বকাপ জয়ের বছরই বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ দিয়ে স্বীকৃত ক্রিকেটে যাত্রা শুরু তরুণ মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানের। পরের বছর বাংলাদেশ ইমার্জিং দলের হয়ে আয়ারল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে লিস্ট ‘এ’ ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের স্বাদ পান তিনি। পরে ঘরোয়া ক্রিকেটে নানান সময়ে প্রতিভার ছাপ রাখেন শাহাদাত। যদিও খুব ধারাবাহিক হতে পারছিলেন না। সমসাময়িক কয়েকজন জাতীয় দলে খেলে ফেললেও তাই একটু আড়ালেই পড়ে যান তিনি। তবে নিজের মতো কাজ চালিয়ে যান। তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখেই তাকে এইচপি ও ‘এ’ দলে সুযোগ দিতে থাকেন নির্বাচকরা। সেটিইর সুফল মিলতে থাকে। টেস্ট দলে তিনি সুযোগ পেয়েছেন মূলত বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে পারফরম্যান্সে। গত ডিসেম্বরে ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে সিলেটে দারুণ ব্যাটিংয়ে তিনি করেন ৮০ রান। সবশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের বিপক্ষে দ্বিতীয় আনঅফিসিয়াল টেস্টে খেলেন ৭৩ ও ৫০ রানের দারুণ দুটি ইনিংস। তবে শাহাদাতের ভাবনায় ছিল না জাতীয় দলের ডাক। ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে সিরিজ শেষে বিশ্রামের জন্য ছুটি পেয়ে তিনি চলে যান পরিবারের কাছে। বাড়িতে বসেই পান জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবর। “আমি ‘এ’ দলে খেলছিলাম। আমাদের তিনটা ম্যাচ ছিল সেখানে। সেদিকেই মনোযোগ ছিল। জানতাম না কী হবে। গত রোববার মাগরিবের আগে সম্ভবত জানতে পারি (জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবর)। নির্বাচকরা ওইরকমভাবে আগে কিছু বলেননি। ডাক পাওয়ার পর (হাবিবুল) বাশার স্যার কল দিয়েছিলেন।” ‘এ’ দলের সিরিজের পর ছুটি কাটিয়ে রাজশাহীতে হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) ইউনিটের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা ছিল শাহাদাতের। কিন্তু এর আগেই পেয়ে গেলেন ‘প্রমোশন।’ তার আনন্দটাও তাই অনুমেয়। “এবার এইচপি দলে যোগ দেওয়া হয়নি। তবে দলে ছিলাম। মূলত প্রিমিয়ার লিগের পর থেকেই ‘এ’ দলের সিরিজ নিয়ে মনোযোগ দিচ্ছিলাম। খুশি তো লাগবেই, স্বাভাবিক। সবারই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে খেলার। আমারও ওই একই খুশি লাগছে।” জাতীয় দলের অংশ হয়ে প্রথম দিন অনুশীলনের অভিজ্ঞতাও শোনালেন শাহাদাত। রোমাঞ্চটা ফুঠে উঠছিল তার কণ্ঠে। “(জাতীয় দলের অনুশীলনে যোগ দেওয়ার পর) আজকে সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছিল। খুব ভালো লেগেছে। সবারই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে খেলার। আমারও তা-ই ছিল। কোচসহ সবাই অভিনন্দন জানিয়েছেন।” টেস্ট স্কোয়াডে সুযোগ পাওয়ার পর এখন তার অপেক্ষা একাদশে সুযোগ পাওয়ার। সেটা এবারও হতে পারে, কিংবা হতে পারে ভবিষ্যতে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে আনঅফিসিয়াল টেস্ট ম্যাচ খেলে টেস্ট ক্রিকেটের স্বাদ কিছুটা পেয়েছেন তিনি। ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে অভিজ্ঞ টেস্ট পেসার উমেশ যাদব, আরেক টেস্ট পেসার নবদিপ সাইনি, রঞ্জি ট্রফির সফল পেসার মুকেশ কুমারকে খেলেছেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের বিপক্ষে খেলেছেন টেস্ট পেসার অ্যান্ডারসন ফিলিপ, রেমন রিফারদের। এই সিরিজেই খেলা ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলার আকিম জর্ডান, জেইর ম্যাকঅ্যালিস্টারদের এখনও অভিষেক হয়নি। তবে দারুণ বাউন্স ও গতিময় বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানদের কঠিন পরীক্ষা নেন তারা। ‘এ’ দলের সিরিজগুলো খেলে নিজেকে আরেকটু চিনেছেন শাহাদাত, পোক্ত করতে পেরেছেন নিজের ব্যাটিং। “ওদের (‘এ’ দলের) বোলাররা একটু কঠিন। ভালো অভিজ্ঞতা থাকে। সবাই আন্তর্জাতিক মানের বোলার যারা ‘এ’ দলে খেলেছে। ভারত ‘এ’ দলেও মোটামুটি ভালো বোলার ছিল। ধৈর্য থাকতে হয়, মানসিকভাবে অনেক শক্ত থাকতে হয়। ওটা যদি মানিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে।” ‘এ’ দলের সবশেষ সিরিজে জাতীয় দলের সাবেক প্রধান কোচ ও বর্তমানে বিসিবির ব্যাটিং পরামর্শক জেমি সিডন্সের সঙ্গে ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেন তিনি। তার টেস্ট দলে জায়গা পাওয়ার খবরে এই কোচও বেশ উচ্ছ¡সিত বলে জানালেন শাহাদাত। “আজকে সকালে (জেমি সিডন্সের সঙ্গে) কথা হয়েছে। ও হয়তো জানতো না। হঠাৎ যখন জেনেছে, খুব খুশি হয়েছে। অভিনন্দন জানিয়েছে।” “স্কিল অনুযায়ী স্পিনে কীভাবে খেলতে হবে বা পেস বল কীভাবে খেলতে হবে, এসব কিছু জিনিস নিয়ে জেমি কাজ করেছে। সেগুলো নিজের মধ্যে আয়ত্ত করার চেষ্টা করছিলাম। বাকিটা যতটুকু হয়েছে আর কি!” স্কিল ও দারুণ টেম্পারমেন্টের কারণে ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচদের প্রিয় শাহাদাত। নিজের ব্যাটিং স্কিল নিয়ে আত্মবিশ্বাসী তিনি নিজেও। তবে সময়ের সঙ্গে সেই স্কিলকে শাণিত করতে চান আরও। জাতীয় দলে দীর্ঘসময় টিকে থাকতে উন্নতি করতে চান মানসিক দিকগুলোতেও। “স্কিল তো ভালো সবাই বলে। আমি অনুভব করি, এখানে খেলার জন্য মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার। দিন দিন যেন আরও উন্নতি করতে পারি, সেই চেষ্টা থাকবে। নিজের স্কিল আরও উন্নত করার চেষ্টা করব। মানসিকভাবে আরও শক্ত হওয়ার চেষ্টা করব। এটাই আমার কাজ। এসব কাজে যত উন্নতি করব, আমার জন্য খেলাটা আরও সহজ হবে।”

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com