এফএনএস : দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। এসব দুর্ঘটনা মহাসড়কে বেশি ঘটছে। অধিকাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা ও মুখোমুখি সংঘর্ষে। মোটরসাইকেল চালকদের অধিকাংশই কিশোর-যুবক। যারা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় শিকার হচ্ছে এবং অন্যদেরও আক্রান্ত করছে। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫ লাখ মোটরসাইকেল চলছে। শুধু রাজধানীতেই চলছে ১২ লাখের বেশি। মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব এবং যানজটের কারণে মোটরসাইকেলের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। যদিও মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে চালকেরা নিয়ম মানছেন না। চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরেন না। এক মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়মটিও মানা হয় না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলও অহরহ চলে। অনেকেরই মোটরসাইকেল চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না। অন্যদিকে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলায় অনেকের কাছে স্বস্তিদায়ক বিকল্প হয়ে উঠছে মোটরবাইক। বাস-ট্রেনের ভোগান্তি এড়াতে গত ঈদে ২০ থেকে ২৫ লাখ মোটরসাইকেলে রাজধানী ছাড়েন নগরবাসী। দুর্ঘটনার শিকার হয় এক হাজার ৬১৮টি মোটরবাইক। আগামী ঈদুল আজহায় এমন প্রবণতা দুর্ঘটনার মাত্রা কয়েক গুণ বাড়াবে বলে আশঙ্কা বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের। এক হিসাবে দেখা যায়, গত ঈদে ২০ থেকে ২৫ লাখ মোটরবাইকে রাজধানী ছাড়েন নগরবাসী। যা দুর্ঘটনার মাত্রাকে আশঙ্কাজনক হারে বাড়িয়ে দেছ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮৩০ জন। ২০১৯ সালে যে সংখ্যা ছিল ৯৪৫ জন। ২০২০ সালে নিহত হন এক হাজার ৪৬৩ জন। আর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান দুই হাজার ২১৪ জন। নিহতদের ৭৫ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মে মাসের প্রথম সাত দিনে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় আহত ১ হাজার ৪৭৪ জন সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কেউ হাত বা পা ভাঙলে সুস্থ হতে ৩ থেকে ৯ মাস সময় লাগছে। পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম দেওয়ান বলেন, আহত হয়ে যাঁরা চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাঁদের বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। আবার তাঁদের ৯০ শতাংশই তরুণ। মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণ বেশি হয় এবং পায়ের হাড় বেশি ভাঙে। এদিকে মোটরসাইকেলের সহজলভ্যতাকে দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ উলেখ করে বুয়েটের এআইআইয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুর নেওয়াজ বলেন, মোটরসাইকেল ঝুঁকিপূর্ণ একটা বাহন কারণ ভারসাম্য ঠিক থাকে না। মহাসড়কে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দূরপালার বাহন হিসেবে ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। এটাকে নিরুৎসাহিত করা খুব প্রয়োজন। পাশাপাশি যারা মোটরসাইকেলে চলবেন, তাদের মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করতে হবে এবং চালক ছাড়া মাত্র একজন যাত্রী পরিবহন করা যাবে। মোটরবাইক চালকদের মানসম্মত হেলমট ব্যবহার ও ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এদিকে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মোটরসাইকেলের সহজলভ্যতাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ছিল ১৫ লাখের কম। বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর ৩ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হচ্ছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পেছনে যেসব কারণ চিহ্নিত করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন, সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে কিশোর-যুবকদের বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানো। এছাড়া অন্যান কারণের মধ্যে রয়েছে, অতি উচ্চগতির মোটরসাইকেল ক্রয় এবং ব্যবহারে সহজলভ্যতা ও বাধাহীন সংস্কৃতি। ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা। দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির শিথিলতা। বাস-ট্রাক-পিকআপ-প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাসসহ দ্রুতগতির যানবাহনের বেপরোয়া গতি। চালকদের অদক্ষতা ও অস্থিরতা। ইজিবাইক-সিএনজি-নসিমন-ভটভটি ইত্যাদি স্বল্পগতির যানবাহন অপরিকল্পিত ও অদক্ষ হাতে চালানো। সড়ক-মহাসড়কে ডিভাইডার না থাকা। সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা না থাকা। পারিবারিকভাবে সন্তানদের বেপরোয়া আচরণকে প্রশ্রয় দেয়া। দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর সংস্কৃতি গড়ে ওঠা ইত্যাদি। বিষেশজ্ঞরা বলছেন, সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে হলে প্রথমেই কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; মাত্রাতিরিক্ত গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে;দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; গণপরিবহন চালকদের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরি করতে হবে এবং স্বল্পগতির স্থানীয় যানবাহন বন্ধ করতে হবে; স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য মহাসড়কের পাশাপাশি সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহন উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার এবং বিস্তৃত করে সড়ক পথের উপর থেকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের মতো পণ্যবাহী যানবাহনের চাপ কমাতে হবে; সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে এবং সড়ক পরিবহন আইন সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।