এফএনএস : ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় দেশে ক্রেডিট কার্ডের বাজার। কারণ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে গ্রাহকদের আয়কর বিবরণী জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্রেডিট কার্ড ছাড়াও ৩৮ ধরনের সেবা নিতেও গ্রাহকদের আয়কর বিবরণী জমা দেয়ার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। তা না হলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা বাজেটে এমন প্রস্তাবকে ক্রেডিট কার্ড বিপণনের অন্তরায় মনে করছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে লেনদেন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন। আর তারই ব্যাংকগুলো অনুষঙ্গ হিসেবে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড নিয়ে এসেছে। কয়েক বছর ধরে দ্রুতগতিতে বাড়ছে প্লাস্টিক মানি বা কার্ডভিত্তিক লেনদেনের পরিমাণ। সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানুষ বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যাও। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে বিপুল বিনিয়োগের প্রস্তুতিও নিয়েছে। এমন অবস্থায় প্রস্তাবিত বাজেট দেশে ক্রেডিট কার্ডের প্রবৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর শঙ্কা বাড়াচ্ছে। সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত বাজেট পাস হলে দেশে ক্রেডিট কার্ডের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদ্যমান ক্রডিট কার্ডের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধিও থেমে যাবে। ফলে হুমকির মুখে পড়বে ক্রেডিট কার্ড ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ব্যাংকগুলোর শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। আর ব্যাংকের চাকরি হারাবে ক্রেডিট কার্ড বিপণন কর্মীরাও। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্রেডিট কার্ডপ্রত্যাশী গ্রাহকরাও। বিগত ২০১৬ সালে দেশে ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত মোট ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ছিল ৯ লাখ। ওই সময় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ৫ বছরের ব্যবধানে দেশে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ও লেনদেনের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৫১। আর ওসব কার্ডের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি উন্নীত হয়েছে ৭ হাজার ২২০ কোটি টাকায়। গত মার্চে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। দেশের ৪০টিরও বেশি সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংক এবং একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে। সূত্র আরো জানায়, চারটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশে ক্রেডিট কার্ড বাজারের বৃহৎ অংশ। বসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে দেশের মোট ক্রেডিট কার্ডের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। কার্ড সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ পাঁচে থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক ও বিদেশী স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) কেবল লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের মধ্যে ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। ক্রেডিট কার্ডের বাজারে ওই প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান পঞ্চম। তবে মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি সমাজের নিম্নবিত্তদের জন্যও ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিয়েছিল দ্য সিটি ব্যাংক। জনবল ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে ব্যাংকটির ক্রেডিট কার্ড বিভাগকে সাজানোর প্রস্তুতিও শেষ হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকটি ওই খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে ক্রেডিট কার্ডের জন্য আয়কর বিবরণী জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে সিটি ব্যাংক। এদিকে বাজেটের প্রস্তাব গৃহীত হলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী জানান, মানুষের কাছ থেকে রিটার্ন আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজস্ব বোর্ডের। কিন্তু ওই দায়িত্ব এখন ব্যাংকসহ অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিতে হলে ট্যাক্স রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার যে বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ক্রেডিট কার্ড কখনই আয় নির্দেশক পণ্য নয়। বাজেটের প্রস্তাবগুলো পাস হলে জনগণের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। একই প্রসঙ্গে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন জানান, ক্রেডিট কার্ড সংখ্যা ও ঋণ বিতরণের দিক থেকে সিটি ব্যাংক সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এতোদিন উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে প্রাধান্য দিয়ে ক্রেডিট কার্ড বিপণন করা হয়েছে। নতুন করে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নবিত্তের কাছেও ক্রেডিট কার্ড পৌঁছার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। গাড়ির ড্রাইভার, গৃহকর্মী থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের ছোট দোকানির জন্যও ক্রেডিট কার্ডের ডিজাইন প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু এখন যদি ক্রেডিট কার্ড নিতে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়, তাহলে ভেস্তে যাবে পুরো পরিকল্পনা।