এফএনএস : পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আসা নতুন মাদক শনাক্তের প্রযুক্তিই দেশে নেই। এ সুযোগে চাহিদা বাড়ায় মাদকের চালান যেমন বাড়ছে, তেমনি নিত্যনতুন মাদকেরও আবির্ভাব ঘটছে। ইতোমধ্যে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আসা সাইকোডেলিক মাদক বা লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথালামাইড (এলএসডি), ডায় মিথাইল ট্রিপ্টামিন (ডিএমটি) ও ম্যাজিক মাশরুম (সিলোসাইবিন) দেশে আসছে। তাছাড়াও নিয়মিত উদ্ধার হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ আইস, নিউ সাইকো-এ্যাকটিভ সাবস্টেনসেস (এনপিএস) বা খাত, এস্কাফ সিরাপ ও ডিওবির মতো মাদক। দেশে নতুন আবির্ভাব ঘটা মাদকগুলোর মধ্যে সাইকোডেলিক মাদকগুলোর চালান ঠেকানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকগুলোর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও পরিচিত নয়। ফলে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা ওসব মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি দেশের বাজারে ওসব মাদকের চালান বাড়তে থাকে তাহলে দাম কমে সব শ্রেণীর মাদকাসক্তদের মধ্যে তা ছড়িয়ে আশঙ্কা রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে সব ধরনের মাদক নির্মূলে চাহিদা হ্রাস করতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। আর শুধু ধরপাকড়ের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) মাদক নিয়ন্ত্রণে কমপ্রিহেন্সিভ এ্যাকশন প্ল্যান বা সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। শুধু ধরপাকড় নয়, ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও সচেতনতা বাড়িয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মশালা করার মাধ্যমে ওই কর্মপরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ডিএনসি ২৫ হাজার ৬৫০টি অভিযানে ৬ হাজারটি মামলা দায়ের করে ৬ হাজার ৫২৫ জনকে গ্রেফতার করে। ওই সময়ে ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭৪৪ পিস ইয়াবা, ১ হাজার ৯২০ কেজি গাঁজা, ৯ হাজার ১৬৯ বোতল ফেন্সিডিল জব্দ করা হয়। আর চলতি বছরের ২ মাসে সব সংস্থা (ডিএনসি, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্ট গার্ড) জব্দ করেছে ৬২ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৮ পিস ইয়াবা। সব সংস্থা মিলে ২০২১ সালে প্রায় ৩৭ কেজি এবং চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৬৮ কেজি আইস জব্দ করেছে। তাছাড়াও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে নিয়মিত ধরা পড়ছে পশ্চিমা দেশগুলোর জনপ্রিয় সাইকোডেলিক মাদক এলএসডি, ম্যাজিক মাশরুম ও ডিএমটির মতো ভয়ঙ্কর সব মাদক। তার মধ্যে এলএসডির ২০টির বেশি চালান জব্দ করা হয়েছে। এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে যারা মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে তাদের দায়িত্বে অবহেলা, অত্যাধুনিক মাদক শনাক্তের প্রযুক্তি না থাকা, মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশসহ নানাকরম ফাঁকি থাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজের কাজ হচ্ছে না। বরং মাদকের সহজলভ্যতার কারণে দিন দিন চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন অনলাইনে অর্ডার দিলে ঘরে বসে মাদক পাওয়া যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি থেকে সত্যিকার অর্থে পরিত্রাণ পেতে হলে সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আসা সাইকোডেলিক মাদক ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় সেগুলো চিনতেই পারে না। একই সঙ্গে লজিস্টিক দুর্বলতাতো আছেই। ওসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে। পাশাপাশি মাদকের বাহকে সীমাবদ্ধ না থেকে হোতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্টদের মতে, কম কষ্টে অধিক টাকা উপার্জনের মাধ্যম হওয়ায় লোভে পড়ে মানুষ মাদক চোরাচালানে যুক্ত হচ্ছে। নিত্যনতুন কৌশলে, এমনকি মহিলা ও শিশুরাও পেটের মধ্য করে মাদক পরিবহন করছে। ওসব ঘটনায় যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে তারা জামিনে বেরিয়ে আবার মাদক ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। সুতরাং শুধু ধরপাকড়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আর এখনো ইয়াবা, গাঁজা ও ফেন্সিডিল মাদকের বাজার দখল করে আছে। যদিও বেশ কিছু পশ্চিমা মাদকের আবির্ভাব ঘটেছে কিন্তু সেগুলো এখনো একচেটিয়াভাবে বাজার দখল করতে পারেনি। মাদক নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধ সামাজিক যুদ্ধ হতে হবে। কারণ শুধু অভিযান পরিচালনা করে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সেজন্য সব স্টেক হোল্ডারকে এগিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফ সীমান্ত দিয়েই ইয়াবা ও আইস আসছে এটা সত্য। অনেক রোহিঙ্গা মাদক চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ায় বিষয়টি আরো ব্যাপকতা পেয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন কৌশলে বিভিন্ন সীমান্ত, আকাশপথ ও বিশাল সমুদ্র এলাকা দিয়েও মাদকের চালান আসছে। আর তখনই তা নির্মূল হবে, যখন আর চাহিদা থাকবে না। বর্তমানেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর অভিযান চলমান রয়েছে এবং থাকবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টিতেও কাজ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন্স) কুসুম দেওয়ান জানান, ভৌগোলিক কারণে মাদকের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল, গোল্ডেন ওয়েজ, গোল্ডেন ভিলেজ ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এলাকাগুলোর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ। তার থেকে পরিত্রাণ পেতে সচেনতার বিকল্প নেই। সেজন্যই সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নামে নতুন কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। আশা করা যায় ওই কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে ডিএনসির জনবল ও লজিস্টিক খুবই কম। আর ওই স্বল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। তবুও ডিএনসি কাজ করে যাচ্ছে।