এফএনএস : দীর্ঘদিন ধরেই দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোচিং পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যা তাদের পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে। অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে কোচিংয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে। তাতে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সম্পর্কিত হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর কোচিং বাণিজ্য বন্ধে একটি গেজেট নোটিফিকেশন বা অন্য কোনোরূপ আদেশ প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি ও হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকার কর্তৃক কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আর ওই নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ছাত্রছাত্রীর তালিকা, রোল, নাম ও শ্রেণি উলেখ করে জানাতে হবে। আর নীতিমালা না মানলে ৩ ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমত, এমপিওভুক্ত হলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন কমিয়ে দেয়া বা বরখাস্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিওবিহীন শিক্ষক হলে প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া বেতন স্থগিত বা চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো ব্যবস্থা নেয়া হবে। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা, বেতন স্থগিতের মতো ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে সরকার ওসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেবে। কিন্তু বাস্তবে ওই নীতিমালা প্রয়োগে গতি নেই। শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১১ সালের উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ দেয়ার ঠিক পরের বছরই কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা জারি করে। যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’। কিন্তু নীতিমালা জারির ১০ বছর পরও মাঠপর্যায়ে ওই নীতিমালা বাস্তবায়নের হার শূন্য ভাগ। কোনো মনিটরিং কার্যক্রমও নেই। তাতে অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হলেও খুশি কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনিতে সুবিধাভোগী শিক্ষকরা। আগামী শিক্ষাবর্ষে ৪টি শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম শুর হবে। ওই কারিকুলামে শিক্ষকদের হাতে অনেক নম্বর রাখা হয়েছে। কোনো কোনো শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষার চেয়েও বেশি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষকের কাছে কোচিং-টিউশনিতে পড়লে বেশি নম্বর দেয়া হবে এমন আশঙ্কা থেকেই কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা শতভাগ কার্যকরের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। নীতিমালা জারির পর এক দশক পর নীতিমালা বাস্তবায়নের তোড়জোড় দেখা দেয়। নীতিমালা ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু সর্বোচ্চ ৬ মাস ওই তোড়জোড় ছিল। তারপর বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং কার্যক্রমও থেমে যায়। প্রাইভেট টিউশনিতে শিক্ষকরা জড়িত মনিটরিং কমিটিতে এমন অভিযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সূত্র জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা তদারকির প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু মাউশির এমনও অনেক কর্মকর্তা আছে যাদের ওই নীতিমালা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। অথচ আদালতের নির্দেশে ওই নীতিমালা জারি হয়েছিল। কিন্তু কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা শিক্ষকরা মানছে এমন কোনো উদাহরণ নেই। কোনো শিক্ষকই ওই নীতিমালা মানে না। নীতিমালা জারির আগে যেভাবে কোচিং বাণিজ্য চলতো এখনো তা আগের মতোই চলছে। শিক্ষকরা নিজ বাসায় পড়ায়। কোনো কোনো শিক্ষক পৃথক বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিংয়ে শিক্ষার্থী পড়ায়। কোনো কোনো শিক্ষকের মতে, অভিভাবকদের আগ্রহের কারণেই শিক্ষকরা কোচিং করায়। আবার কোনো কোনো অভিভাবকের মতে, বাধ্য হয়েই সন্তানদের প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়াতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে শুধু বেসরকারি শিক্ষকরা নন, সরকারি স্কুলের শিক্ষকরাও কোচিং বাণিজ্যে জড়িত। স্কুলের পাঠদানে শিক্ষকরা মনযোগী নয়। সূত্র আরো জানায়, কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজধানীর ৮ প্রতিষ্ঠানের মোট ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান, পরিচালনা পর্ষদ এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবকেও দুদকের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। ওই আলোকে ২০১৮ সালে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর ৫টি সরকারি বিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষককে বিভিন্ন জেলায় বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু যারা বদলি হয়েছিল তারা আবারও ঢাকায় ফিরে এসেছে। অন্য কোথাও শাস্তি দেয়া হয়েছে এমন বড় কোনো উদাহরণ নেই। তাছাড়া নীতিমালায় বদলির কথা নেই। যে তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে তার একটাও তাদের ক্ষেত্রে নেয়া হয়নি। বিগত ২০১৯ সালের আগস্টে মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদারের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের সভা হয়েছিল। কিন্তু ওই সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা বাস্তবায়নের ধারেকাছে নেই। এদিকে এ বিষয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসাইন জানান, একবার ২৫ জন শিক্ষককে বদলি করা হয়েছিল। পরে দুদকের সুপারিশ নিয়ে তারা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি নিয়েছে। মাঠপর্যায়ে ওই নীতিমালা বাস্তবায়ন হচ্ছে না এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ের পরিচালক ও উপ-পরিচালকদের বলে দেয়া হয়েছে যাতে ওই নীতিমালা বাস্তবায়নে তারা কঠোর হন। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, কোচিংকে একটা শঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। কোচিংয়ের অনৈতিক দিকগুলো বন্ধ করা দরকার। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায় শিক্ষক কাকে, কোথায় পড়াতে পারবেন সেই বিষয়গুলো বলা হয়েছে।