মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪৭ পূর্বাহ্ন

শিক্ষকরা লাইনচ্যুত \ কমেছে শিক্ষক-ছাত্রের বন্ধন

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২

জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে \ শিক্ষকরা লাইনচ্যুত হওয়ায় কমেছে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যকার বন্ধন। এ ধরণের সামাজিক অবক্ষয় থেকে ছাত্রের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে শিক্ষকরা। এ ইস্যুতে উদ্বেগ বেড়েছে। উদ্বিগ্ন শিক্ষক-অভিভাবক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তবে সব কিছু ছাপিয়ে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের অবনতির পেছনে আর্থিক বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষার বাইরে শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মূখ্য বিষয় বলে মনে করছেন। ঢাবির অপরাধ ও তথ্য বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, আমাদের বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা হচ্ছে, – সেখানে মূখ্য বিষয় সামাজিক প্রতিপত্তি বা স্ট্যাটাস নির্ধারণের জন্য কার কত অর্থ এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী আছে তার উপরে। যার-কারণে আপনি একজন ভালো শিক্ষক, সৎ-জীবন যাপন করেন , নিয়ম-কানুন মেনে চলেন এবং আইন মোতাবেক চাকরিতে কাজ করেন এগুলো আজকাল নীতি বাক্যতে পরিণত হয়েছে। কারণ আপনার অর্থ ও প্রতিপত্তি কোনোটাই নেই। সামাজিব প্রতিপত্তী নির্ধারণে মর্যাদা নির্ধারণে দুটাই নির্ণায়ক একটি অর্থ এবং অন্যটি রাজনীতি। তিনি বলেন, আপনার বাবা গর্ভনিং বডির চেয়ারম্যান আপনার নিয়ম মানার দরকার নেই। বিষয়টি এখন হয়ে গেছে এই রকম। কেননা সামাজিক ব্যবস্থায় যখন পুরোপুরি মূল্যায়নের মানদন্ড তৈরি হয়; সেই মূল্যায়নগুলো একসময়ে ভেঙে যায়। এগুলো যখন রাজনীতিক ও সমাজিকভাবে নির্ধারণ ( প্রোমোট) করে দেয়া হয়, – তখন শিক্ষকদের কখনই শিক্ষার্থীরা মানবে না। সামাজিক এই অবক্ষয়ের জন্য এখন অনেকেই বলে থাকেন শিক্ষকদের হাতে বেত নেই বলে এটা হচ্ছে। কিন্তু আমি ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। কারণ দেখতে হবে একজন শিক্ষার্থী যখন ছোট ছিল ওই সময়ে পরিবার থেকে সে কি শিক্ষা পেয়েছিল এবং সে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে কি নীতি-নৈতিকতায় বড় হচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক পুলিশের মহা-পরিদর্শক (আইজিপি) মো. শহীদুল হক বলেন, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনাগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের অংশ। এটা আমাদের রন্ধে রন্ধে কমিউনিটির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সমাজ পরিবর্তনের কারণে এটা হয়। তবে শিক্ষকদের অনেক সময় ত্র“টি থাকে। একজন শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির মেরুকরণে নিজেকে সম্পৃক্ত করা এটাও সামাজিক অবক্ষয়ের অংশ। কিন্তু শিক্ষাকতা মহান পেশা তাদের শুধু শিক্ষার্থী নয় অভিভাবকসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও সম্মান করেন। তবে তাদের ভাবমূর্তি বজায়র রেখে চলার ক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন হয় সেখানে ব্যত্যয় ঘটে। তার মানে এই নয় শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ বা হেনস্থ করবে, শারীরিকভাবে নির্যাতন করবে এটাতো ছাত্ররা করতে পারে না। শিক্ষক যদি লাইনচ্যুত হয়ে যায় ও নীতি-নৈতিকতা না থাকে সেটা সমাজ দেখবে , -এই ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কোন অংশ হতে পারে না। সামাজিক অবক্ষয় থেকে উত্তরণের পথ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ থেকে উত্তরণ কঠিন। একক কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না। এর জন্য সময় লাগবে। সমাজ যেভাবে পরিবর্তন হয়, কেউ তা রোধ করতে পারে না। তবে সমাজ পরিবর্তনের কারণেই এই সামাজিক অবক্ষয়। এটা রোধ করতে পারে পরিবার। তাদের যদি নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া হয়। একজন শিশু কথা বলা শুরুর পর থেকেই নানাভাবেই তার হ্নদয়ে ভালো ও ইতিবাচক দিকগুলোকে ঢুকিয়ে দেয়া। বর্তমানে যদিও নতুন প্রজন্মকে নিয়ন্ত্রন করা কঠিন, তার পরও হতাশ হলেই চলবে না। একজন শিশুর পাঠশালা তার পরিবার। এর পর স্কুল-কলেজের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি জায়গা ঠিক থাকলে সামাজিক অবক্ষয়ের যে ধারণা চলছে সেটার পরিবর্তন হওয়া সম্ভব । জাতীয় মানষিক ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, এটা একটি জটিল প্রসঙ্গ। শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্ররা অন্তর্ভুক্ত হয়, কিন্তু এর সঙ্গে শুধু তারাই জড়িত না। এর সঙ্গে স্থানীয় কিছু মানুষজন থাকে, স্কুলের সঙ্গে জড়িত কিছু লোকজন থাকে, এর থেকে বোঝা যায় ছাত্ররা কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহ্নত হয়। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পেছন থেকে কেউ কেউ কলকাটি নাড়ে। ছাত্রকে ব্যবহার করে মানুষের সেন্টিমেন্ট কাজে লাগায়। সাম্প্রতিক ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগানো হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। মানা-মান্যতা শুধু শিক্ষকের ক্ষেত্রে হবে কেনো সম্মানি ব্যক্তি সবাইর জন্য হওয়াই শ্রেয়। মনরোগ এই চিকিৎসক বলেন, শিক্ষকের কিছু ভূমিকা আছে; তবে প্রধান রোল বলা যাবে না। কোনো কোনো শিক্ষকের বাণিজ্যিক প্রবণতা রয়েছে; যেটা ছাত্রদের কাছে ধরা পড়েছে। তারা ওই শিক্ষককে শ্রদ্ধা করতে পারে না। এ ধরণের ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে কিছু শিক্ষকের ইন্ধন থাকে। ফলে যিনি ইন্ধন দিচ্ছেন এবং যার বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া হচ্ছে কারো প্রতিই শিক্ষার্থীদের সম্মান থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। এসব নানা অনৈতিক কারণে মূলত সামাজিক অবক্ষয় থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। তার পরও বলব শুধু শিক্ষকরাই দায়ী না; সামগ্রকিভাবে সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে এ থেকেই মানা-মান্যতা বোধ কমে যাচ্ছে। তবে একজন রোগী যখন আমার কাছে আসবে তখন আমি চিন্তা করব সে মানষিক অসুস্থ থেকে এটা করছে না কি আচরণগত সমস্যা থেকে এটা করছে সেটা নির্ণয় করা। কিন্তু সামাজিক প্রসঙ্গেটি যখন আসবে ব্যক্তি টু ব্যক্তি বিবেচনা করা যাবে না। সমাগ্রীকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। তাহলেই কিছুটা সামাজিক যে অবক্ষয় হয়েছে এর থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটানো যাবে। সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে, এটাতো বটেই। কারণ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, মমত্ববোধ এগুলো ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। অসিহষ্ণুতা সমাজের সর্বত্রই বিরাজ করছে। আর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকরণ এমনভাবে রুপ নিয়েছে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক হচ্ছে টাকার ভিত্তিতে। অর্থাৎ এখানে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের চেয়ে টাকার সম্পর্কটাই প্রধান। উলে­খ্য, স¤প্রতি ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নূপুর শর্মার সমর্থনে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষার্থীর পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এরপর গুজব ছড়িয়ে পড়ে পোস্ট দেওয়া ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসএকই সময়ে সাভারে শিক্ষক হত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০১৩ সালে পাবনায় একজন ছাত্র তথাকথিত অভিযোগে শিক্ষককে দুই হাতে ইট দিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। এছাড়া শিক্ষক কান্তি ও হ্নদয় মন্ডলের ঘটনা ঘটেছিল। এসব ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com